কক্সবাজারে সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে প্রাইভেট বীচ রিসোর্ট
স.ম ইকবাল বাহার চৌধুরী, কক্সবাজার
কে বেশী শক্তিশালী? জেলা প্রশাসন নাকি মারমেইড কর্তৃপক্ষ? এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের। একের পর এক সরকারী জায়গা ও ইসিএভুক্ত সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাইভেট বীচ রিসোর্ট। ওই বালিয়াড়ি দখলমুক্ত করার অভিযান চলমান থাকলেও রহস্যজনক কারণে এই ‘মারমেইড বীচ রিসোর্টে’ এর প্রভাব পড়ছে না তার ছিটেফুটাও। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেও নির্লজ্জ ভাবে কিছুই যেন হচ্ছেনা এমন ভাব নিয়ে আছে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন। ২১ নভেম্বর ২৪ তারিখ লোক দেখানো এক অভিযান পরিচালনা করে গেলেও মারমেইড যেন মারমেইডই একশো।এত সব অভিযোগের মাঝে গত ২১/১১/২০২৪ ইং তারিখ (বন মামলা ১১৫/২৪ রামু) কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ মারমেইড বীচ রিসোর্টের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছিল। প্রভাবশালী ওই রিসোর্ট মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করায় নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে হিমছড়ি বিট কর্মকর্তা কামরুজ্জামান শোভনকে। তারপরও গত ১৭/১২/২৪ ইং তারিখ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কক্সবাজার দক্ষিনের সূত্র ধরে ধুয়াপালং রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ মোসাদ্দেক হোসেন ২২.০১.২২০০.৭৯৮.১১.০০১.২৪/৪৫৮ স্মারকে যৌথ জরিপের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণের জন্য মারমেইড ইকো ট্যুরিজম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল হক চৌধুরী সোহাগ বরাবরে একখানা নোটিশ প্রেরণ করলেও মারমেইড কর্তৃপক্ষ তা গ্রহন না করে ফেরৎ দেয়। এরা এদের জায়গা সীমানা নির্ধারণ করতে রাজি নয় এমনটি জানাল বন বিভাগের এক কর্মকর্তা। না প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামীলীগের আমলে তারা মন্ত্রী এমপিদের ভয় দেখিয়ে এবং হয়রানী করে মুখ বন্ধ রাখতো। অথচ সেই তারা এখনো ক্ষমতা দেখায়। পেঁচারদ্বীপ এলাকার কফিল জানান,
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই রিসোর্ট মালিক ছিলেন কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির কাছের লোক। আর এখন ক্ষমতা দেখানো হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতার। রামু পেঁচারদ্বীপ সৈকতের বালুচরের ওপর নির্মিত অন্তত ৫ একর এলাকার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল গত ২১ নভেম্বর। দিনব্যাপী অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করা হলেও আবারও সেই স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে একই স্থানে। বালিয়াড়িতে স্থাপনা গড়ে সেখানে করা হয়েছে ফুল মুন পার্টি। অভিযানকালে কাঠের সেতু ভাঙা হলেও ফের তা মেরামত করে চালু করা হয়েছে বালিয়াড়িতে থাকা রিসোর্টগুলো।
রামু উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাজ্জাদ জাহিদ রাতুল জানান, গত মাসে অভিযান পরিচালনা করা হলেও আবারও স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে কিনা তা জানা নেই। এদিকে গত ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রায় ২০ একর জমিতে জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও তৎকালীন কিছু এমপি মন্ত্রীর দাপট দেখিয়ে সেই জমি দখলে নিয়ে তৈরি করেছে ‘মারমেইড বীচ রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ’। তারপর থেকে বর্তমানে ৬০ একরেরও বেশী সরকারী জায়গা দখল করে স্থাপনা করে ভিআইপি রিসোর্ট করে আছে।
রিসোর্টের এলাকা বাড়াতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে দরিয়ানগর সৈকতের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্রাকৃতিক খাল ভরাট করে রেস্তোরাঁ তৈরির চেষ্টা চলছিল বেশ কিছুদিন আগে থেকে। অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইসিটিমন্ত্রী পলকসহ একাধিক মন্ত্রী-প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সম্পর্কের বলয় দেখিয়ে একের পর এক সমুদ্র্রের বালিয়াড়ি দখল করেছেন রিসোর্টটির মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগ।
নিজেকে শেখ পরিবারের একজন দাবি করা সোহাগ দখলবাজি চালিয়ে গেলেও অজানা কারণে গত ১৫ বছর প্রশাসনের কেউ সেদিকে নজরও দেননি। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রশাসনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বহমান খালের ওপর অবৈধ একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেতুর ওপর দিয়ে যেতে হয় সেই বিশেষ ডিজে ও মদের জোনে। তবে সেতুর কারণে খালে নৌকা চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে বরাবরই। পর্যটনের দোহাই দিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড চললেও প্রশাসনের নীরবতায় প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয় লোকজনের মনে।
অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজারে ভিআইপি লোকজন আসলে এই রিসোর্টে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন অনেকে। রিসোর্টের মালিক সোহাগ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম দিয়ে বিশাল বালিয়াড়ি দখল করে সমুদ্র সৈকতে গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য। এই বালিয়াড়ি যেন তার নিজস্ব সম্পদ এমনভাবে ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে। নামমাত্র পেঁচারদ্বীপ মৌজায় বিএস ৫৫০ সৃজিত খতিয়ানে ৫.৩৫১২ একর ও ৬৭৯ সৃজিত খতিয়ানে ১.০৭ একর সহ দুটি খতিয়ানে ৬.৪২১২ একর মাত্র জায়গা ‘মারমেইড বীচ রিসোর্টর নামে থাকলেও তার ১০ গুণ অবৈধ দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে সামাজিক অবক্ষয়, উঠতি বয়সের যুবক-শিক্ষার্থীরা লিপ্ত হচ্ছে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
এ ছাড়াও অবৈধ দখলদারিত্বের কারণে সরকার যেমন হারিয়েছে জমি, তেমনি পরিবেশ প্রকৃতির ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান সমাজের সচেতন নাগরিকরা। অথচ এই সরকারী ভুমিদস্যুকে জেলা প্রশাসন থেকে থার্টি-ফাস্টের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেন নির্লজ্জ ভাবে এমনটি জানালেন স্থানিয় এক শিক্ষক। বর্তমানে পর্যটন মৌসুম হওয়ার কারণে এখন প্রতিষ্ঠানটি ডিজে ও মদের পার্টির জন্য বিশেষ জোন তৈরি করেছে ঝাউবীথির বাগানে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফুল মুন বীচ পার্টি’। এটা করতে গিয়ে কাটা পড়েছে শত শত ঝাউগাছ। উপড়ে ফেলা হয়েছে সমুদ্রসৈকত রক্ষায় রোপণ করা ঝাউবীথি। যার ফলে পরিবেশের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের একমাত্র মেরিন ড্রাইভ সড়ক।
সম্প্রতি সরেজমিনে মারমেইড রিসোর্টে দেখা যায়, পর্যটক বা স্থানীয় লোকজন সেতু দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। পরে বিশেষ টোকেন হাতে দেওয়ার পর প্রবেশ করতে পারেন পর্যটকরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কৌশলে সেই সেতু দিয়ে বিশেষ জোনে গিয়ে দেখা মিলে শত শত ঝাউবীথি কেটে তৈরি করা হয়েছে নাচ-গানের মঞ্চ, কফিশপ, মদের বার সদৃশ্য বিশেষ জোন। এটি মূলত সমুদ্রে গজিয়ে ওঠা চর। জানা গেছে, জায়গাটিতে ঝাউবীথি রোপণ করেছিল উপকূলীয় বন বিভাগ। যেগুলো কেটে স্থাপনা তৈরি করেছে মারমেইড কর্তৃপক্ষ।
পরিবেশবাদী সংগঠন বাপা কক্সবাজার জেলা সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ কলিম বলেন, মারমেইড সৈকতের বালিয়াড়ি সহ শত কোটি টাকার সরকারী জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে ব্যবসা করছে। পরিবেশ প্রতিবেশের বারটা বাজিয়ে ছাড়ছে ইসিএভুক্ত জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করে। অথচ কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ঘুমিয়ে আছে যেন। টাকার কাছে সব কিছু যেন মুখ তুবড়ে পড়ে আছে।
মন্তব্য নিতে গেলে মোঃ সাজ্জাদ জাহিদ রাতুল সহকারী কমিশনার (ভূমি) বলেন, আপনার কাছ থেকে জানলাম, জেলা প্রশাসক মহোদয় নির্দেশ দিলে আবার অভিযান করবো। সরকারী সম্পদ রক্ষায় আপনাদের নিজস্ব কোন করনীয় আছে কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি জেলা প্রশাসকের নির্দেশনার কথাই শুধু বলেন।
এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ইয়ামিন হোসেনকে তাঁহার সরকারী মুটোফোনে বার বার ফোন করেও রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।