ডার্ক মোড
Wednesday, 08 January 2025
ePaper   
Logo
ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধিতে পাবনায় সরিষা চাষে ঝুঁকছেন কৃষক

ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধিতে পাবনায় সরিষা চাষে ঝুঁকছেন কৃষক

পাবনা প্রতিনিধি

পৌষ ও মাঘ নিয়ে শীতকাল। তাই প্রকৃতিতে বইছে এখন শীতল হাওয়া। গ্রাম বা শহর ভোর হলেই দেখা মিলে কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশ। তবে শহরের চাইতে গ্রামের শীতটা একটু অন্যরকম। শীতকাল আসলেই গ্রামে একটি উৎসবমুখোর পরিবেশ বিরাজ করে। কৃষকের মুখেও ফুটে ওঠে অফুরন্ত হাসি। কারণ এই সময়টায় শীতকালীন বিভিন্ন সবজি চাষে কৃষক বেশ লাভবান হয়ে থাকেন।

তেমনি কৃষিতে সমৃদ্ধ একটি গ্রাম হান্ডিয়াল। চলনবিল অধ্যুষিত চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়ালে প্রধান আবাদ ধান হলেও বর্ষা মৌসুমে ডুবে থাকা এ অঞ্চলটিতে বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রকমের শীতকালীন সবজি ও সরিষা চাষে ব্যস্ত হয়ে পরেন কৃষক। এক সময় এই মৎস্য ভান্ডারকৃত চলনবিল আট থেকে নয় মাস পানিতে ডুবে থাকলেও কালের পরিক্রমায় এ বিলে এখন আর আগের মত পানি থাকে না। তবে বিলে পানি না থাকলেও কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে ঠিকই।

কৃষি আধুনিকায়নের ফলে চলনবিলে ধানের পাশাপাশি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রধান ভোজ্য তেল ফসল সরিষার চাষ।

জানা যায়, শীত মৌসুমে চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও উল্লাপাড়া এবং পাবনা সদর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর সহ জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় অধিক পরিমাণে সরিষার আবাদ হয়ে থাকে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল, ফরিদপুরের সোনাহারা, ভাঙ্গুড়ার খানমরিচ, সদর উপজেলার গয়েশপুর সহ জেলার বিভিন্ন মাঠ জুড়ে শুধুই হলুদ সরিষা ফুলের সমারোহ। হলুদ ফুলের গন্ধে যেন এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। হলুদ ফুলের হাসিতে ভরে উঠেছে প্রকৃতির সৌন্দর্য। যতদূর চোখ যায় কেবল হলুদ আর হলুদ।

ধীরে ধীরে বেলা গড়িয়ে নামছে বিকেল। বিকেলের রোদের আলোয় হলুদ ফুলের রূপ যেন আরও প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলছে। মিষ্টি বাতাসে দুলে ওঠছে ফুলের ডগা। ফিরে আসতে শুরু করেছে শিশিরের দল। চির সবুজের বুকে এ যেনো এক কাঁচা হলুদের আল্পনা। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই যেনো ফুলের মেলা। মৌমাছিও ব্যস্ত সময় পার করছে মধু আহরণে। প্রকৃতি সেজেছে এক অপরূপ সৌন্দর্যের নান্দনিক রূপে। এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে ভিড় করছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা। আর সরিষার ভালো ফলন নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন কৃষকেরা।

কৃষি বিভাগ সুত্রে জানা যায়, এবছর চলতি মৌসুমে পাবনা সদর উপজেলায় সরিষার চাষ হয়েছে ৯ হাজার ৮৭৫ হেক্টর, আটঘরিয়ায় ৫ হাজার ১৬৬ হেক্টর, ঈশ্বরদী ১ হাজার ৭৭৫ হেক্টর, চাটমোহর, ৮ হাজার ৩৯৬ হেক্টর, ভাঙ্গুড়া, ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর, ফরিদপুর ৪ হাজার ১৫৪ হেক্টর, বেড়া ৪ হাজার ৪৯৮ হেক্টর, সাঁথিয়া ২ হাজার ৭৪০ হেক্টর, সুজানগর ১ হাজার ৬৮৬ হেক্টর সহ মোট আবাদ হয়েছে ৪৪ হাজার ৮৯০ হেক্টর। তবে এবছর সরিষার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ হাজার ৫০০ হেক্টর। এছাড়াও এবছর টরি-৭, বারি সরিষা-৯, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮, বিনা সরিষা-৯, রাই-৫ সহ বেশ কিছু জাতের সরিষা বেশি আবাদ করা হয়েছে।

এছাড়াও জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, জেলায় ৪৪ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমির মধ্যে ৯ হাজার ৬২৩ হেক্টর জমি মৌচাষের আওতায় রয়েছে। জেলায় ১০ হাজার মৌবক্সের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এসব জমিতে ৬১ জন মৌচাষি ৭ হাজার ৫৮ টি মৌবক্স স্থাপন করে মধ্য সংগ্রহ করছেন। এপর্যন্ত ২৯ হাজার ১৭৫ কেজি মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। এর বিপরীতে মৌবক্সে মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ কেজি। গতবছর জেলায় মধু উৎপাদন হয়েছিলো ১ লাখ ৮ হাজার কেজি।

কথা হয় হান্ডিয়াল সোনাবাজু এলাকার সরিষা চাষি হাকিমের সাথে তিনি জানান, এবছর ৯ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন তিনি। এ বছর আবাদে বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে তার ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, এবছর আবহাওয়া ভালো থাকায় সরিষা গাছ অনেক ভালো হয়েছে ফুলও আসছে অনেক। আবহাওয়া অনূকূলে থাকলে এবং ঠিক মত পরাগায়ন ঘটলে এবছর বিঘা প্রতি ৭ থেকে ৮ মণ সরিষা পাবেন বলে জানান তিনি।

কথা হয় পাকপাড়া গ্রামের সরিষা চাষি মুকুল হোসেন'র সাথে তিনি জানান, এবছর ৪ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন তিনি। স্বল্প সময় ও স্বল্প খরচে লাভ বেশি হওয়ায়, এবছরও সরিষার চাষ করেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলে, ভালো ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান এই চাষি।

কথা হয় নবীন গ্রামের সরিষা চাষি আলাউদ্দিনের সাথে তিনি জানান, এবছর সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করছেন তিনি। তিনি আরও জানান, সয়াবিনের উপর নির্ভরতা বাড়ায় বর্তমানে সরিষা চাষ অনেকটাই কমে গেছে। তবে বর্তমানে ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়, নিজ পরিবারের চাহিদা মিটাতে এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়ার আশায় ধান চাষের পাশাপাশি এবছরেও সরিষার আবাদ করেছেন তিনি।

কথা হয় ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামের মৌচাষি আমজাদের সাথে তিনি জানান, এবছর সরিষা মাঠে ১৫০ টি মৌবক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন তিনি। এবছর সরিষার ফুল ভালো হওয়ায় সপ্তাহে প্রতিটি মৌবক্স থেকে প্রায় ৩ কেজি করে মধ্য সংগ্রহের আশা করছেন এই মৌ চাষি।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দীন বলেন, রোপা আমন এবং বোরো চাষের মধ্যে সরিষা চাষ কৃষকদের জন্য খুবই লাভজনক। তাই কৃষকের জমি তিন ফসলি করতে কৃষকদের সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ করা সহ আমরা বিভিন্ন সহোযোগিতা করে আসছি।

তিনি বলেন, এবছর জেলায় ৪৪ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এবং সরিষা সহ বিভিন্ন ফসল আবাদে প্রায় ৭২ হাজার কৃষককে প্রণোদনার আওতায় বীজ এবং সার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও এ কর্মকর্তা বলেন, এবছর আবহাওয়া ভালো থাকায় সরিষা গাছ অনেক ভালো হয়েছে এবং আমরা আশা করছি ফলনও অনেক ভালো হবে। তিনি বলেন, এবছর সরিষার সঠিক মূল্য পেলে আগামী বছর এ জেলায় সরিষা আবাদ আরও বৃদ্ধি পাবে।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন