
ভার্জিনিয়ায় ‘৫২ থেকে ২৪’ গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
যুক্তরাষ্ট্র ব্যুরো
হার্নডন, ভার্জিনিয়া, ৯ ফেব্রুয়ারি: ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোর স্মরণে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার হার্নডনে অনুষ্ঠিত হলো এক ব্যতিক্রমী আয়োজন। রবিবার দুপুরে ফ্রাইং প্যান ফার্ম ভিজিটর পার্কের অডিটোরিয়ামে দুই ঘণ্টাব্যাপী এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, চিত্রপ্রদর্শনী ও স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই আয়োজনে আয়োজকরা বলেন, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিতেই এই আয়োজন।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘৫২ থেকে ২৪ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা, যেখানে বাংলাদেশে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতা নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট বক্তারা। আলোচনায় অংশ নেন সুলতানা নাসিরা খান, হিরন চৌধুরী, রুনা হক ও মারুফ রহমান। আলোচনার সঞ্চালনায় ছিলেন আনোয়ার ইকবাল।
বক্তারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। ২০২৪ সালের আন্দোলনকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করে তারা বলেন, “এই অভ্যুত্থান শুধু একটি প্রতিবাদ নয়, এটি প্রমাণ করে যে নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই কখনো থামে না।” এ সময় একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে ১৯৫২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিল ধ্রুপদ সাংস্কৃতিক সংগঠনের দলীয় নৃত্য, যেখানে নৃত্যশিল্পীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে স্মরণ করে রচিত জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। নৃত্য পরিচালনা ও কোরিওগ্রাফি করেন অপর্ণা মিত্র। তাদের নৃত্যে উঠে আসে বাঙালির সংগ্রামের চিত্র, যা দর্শকদের আবেগাপ্লুত করে।
এছাড়া, স্বাধীনতা ও গণঅভ্যুত্থান নিয়ে বেশ কয়েকটি আবৃত্তি পরিবেশিত হয়, যেখানে আবৃত্তিকাররা নিজেদের কণ্ঠে তুলে ধরেন মুক্তির চেতনা ও সংগ্রামের ইতিহাস। স্বাধীনতা-সংগ্রাম সম্পর্কিত সঙ্গীত শিল্পীদের গান পরিবেশনা দর্শকদের আবেগে আন্দোলিত করে।
আয়োজনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল চিত্রপ্রদর্শনী, যেখানে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের আত্মত্যাগের চিত্র ফুটে ওঠে। ছবির ক্যানভাসে উঠে আসে রাজপথে বিক্ষোভরত ছাত্রদের দৃশ্য, নিপীড়নের শিকার সাহসী তরুণদের মুখচ্ছবি ও তাদের আত্মত্যাগের স্মরণীয় মুহূর্ত।
এছাড়া, ডিসি-মেরিল্যান্ড-ভার্জিনিয়া (ডিএমভি) এলাকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা কিভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তার ওপরও একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি যুক্ত থাকা তরুণ প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিচারণ করেন, যা উপস্থিত দর্শকদের আবেগাপ্লুত করে। সবশেষে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ছাত্রদের বর্বর হত্যাযজ্ঞ এবং শহীদ পরিবারদের স্মৃতিচারণের ওপর দুটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এর মধ্যে একটি প্রামাণ্যচিত্র ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের করা, যা ২০২৪ সালের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও জনগণের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করে। আরেকটি ছিল “যাত্রাবাড়ী ম্যাসাকার”, যেখানে গণঅভ্যুত্থানের সময় যাত্রাবাড়ীতে সংঘটিত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরা হয়।
সমাপ্তি বক্তব্যে বক্তারা বলেন, “গণতন্ত্র ও ন্যায়ের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ কখনোই ভোলা যাবে না।” তারা আরও বলেন, “ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব সবার, আর সেই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে।”
অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় ছিলেন মেজর (অব.) শাফায়াত আহমদ। এই আয়োজনের সার্বিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ফারজানা ক্লারা। এছাড়া, পুরো আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করতে আয়োজক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন লিনিয়া নাজমী নন্দীনি, আনোয়ার হোসেন সুমন ও অনুপ রায়হান। তাদের নিবেদিত প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠানটি এক স্মরণীয় আয়োজন হয়ে ওঠে।