বর্তমান এবং আগামীর সম্ভাবনাময় সবুজ প্রযুক্তি
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
সবুজ প্রযুক্তি যা টেকসই প্রযুক্তি নামেও পরিচিত। এটি পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন থেকে উত্তরণে সবুজ প্রযুক্তিকেই মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। টেকসই প্রযুক্তিগত বিপ্লবই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। পরিবেশ বান্ধব টেকনোলজি প্রযুক্তি প্রবণতা আমাদের যেমন ভবিষ্যৎ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেয় ঠিক তেমনি একই সঙ্গে ভবিষ্যতের সুযোগ, সম্ভাবনা আর চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। সবুজ প্রযুক্তি আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের প্রভাব মোকাবেলার সর্বোত্তম পালন করে থাকে।
পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে যার মধ্যে কিছু ইতিমধ্যেই নিঃশেষ বা ধ্বংস হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় বিপন্ন পৃথিবীর প্রাণ। তাই পৃথিবীকে বাসোপযোগী রাখতে প্রয়োজন বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে এ সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমাদের এই গ্রহের জলবায়ু প্রতিনিয়ত দ্রুত পরিবর্তনের সম্মুখীন হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ক্রমবর্ধমান তীব্র খরা, ভূগর্ভস্থ জলের মজুদের ক্রমবর্ধমান হ্রাস, সমুদ্রের জলের অম্লকরণ, সমুদ্রের জলের স্তর বৃদ্ধি, রোগের দ্রুত বিস্তার এবং ম্যাক্রোপ্যারাসাইট এবং প্রজাতির বিলুপ্তি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ বিপন্নতা বর্তমান বিশ্বের একটি চরম সংকট। মানুষের প্রতি প্রকৃতির বৈরী আচরণ অত্যন্তই বেদনাদায়ক। কারণ নির্বোধ শিশু থেকে নির্বাক বৃদ্ধ- সবাইকেই হরণ করে নেয় এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, বনভূমি ধ্বংস ইত্যাদি কারণে বসবাসযোগ্য পৃথিবী ক্রমেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। তাই পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবুজ প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। সবুজ প্রযুক্তির সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণগুলির মধ্যে একটি হল সৌর কোষ , যা ফটোভোলটাইক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক আলো থেকে শক্তিকে সরাসরি বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই ইতিমধ্যে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করছে। সৌর ও বায়ু শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অনেক দেশেই কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও উইন্ড টারবাইন বা বাতাসের বেগকে কাজে লাগিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ। সবুজ প্রযুক্তির মূল লক্ষ্য হলো পরিবেশ রক্ষা করা। এ ছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে অতীতে যে ক্ষতি হয়েছে তা দূর করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা। পরিবেশবান্ধব এই সবুজ প্রযুক্তির নতুন অগ্রগতি প্লাস্টিক দূষণ, খাদ্য বর্জ্য, বন উজাড় এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলি সমাধান করতে সহায়তা করে। পরিবেশ বান্ধব সবুজ প্রযুক্তির পাশাপাশি খুব সহজেই সবুজ অর্থনীতি করে তোলা সম্ভব। সবুজ অর্থনীতি হলো সেই অর্থনীতি, যা মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে কিন্তু একই সঙ্গে পরিবেশগত ঝুঁকি কমাবে এবং অভাব দূর করবে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে অর্থনৈতিক উন্নয়নই সবুজ অর্থনীতি।
প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপেক্ষা করে উন্নত সমৃদ্ধ সমাজ, অর্থনীতি, সুন্দর জীবনযাপনের কথা ভাবা যায় না। সুন্দর অনুকূল পরিবেশ উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশ যদি বিপন্ন হয় তাহলে অর্থনীতিও বিপন্ন হবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামগ্রিক সমৃদ্ধির জন্য পরিবেশগত ভারসাম্য ও অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি এখন জোর দিচ্ছেন বিশ্বের সকল দেশ । অতীতে এ বিষয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই তেমন কোনো সচেতনতা ছিল না। কিন্তু বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও নগর সভ্যতার ক্রম বিকাশের প্রভাবে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি এবং ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটায় এখন বিশ্বের প্রায় সকল দেশই এ বিষয়ে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ যখন হুমকির মুখে পড়েছে তখন থেকেই গ্রিন ইকোনমির ধারণা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সবুজ শিল্পের প্রসার ছাড়া পরিবেশ রক্ষা করা কঠিন।
এ জন্য সারা বিশ্বই এখন গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী মানুষের জন্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। এমনিতেই আমাদের এই পরিবেশের যথেষ্ট বিপর্যয় ঘটেছে। পৃথিবীর আবহাওয়াতে যে পরিবর্তন এসেছে তাতে একদিকে যেমন শীতের প্রকোপ বাড়ছে অপরদিকে সেই সঙ্গে আবার অসহনীয় গরমে অস্থিরতায় ভুগছে বিশ্ববাসী । যেসব উপকরণ পরিবেশের বিপর্যয় ঘটায় সেসব শনাক্ত করার পাশাপাশি এসব উপকরণের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাতে গ্রিন টেকনোলজি বা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
গড়ে তুলতে হবে সবুজ বেষ্টনী। বর্তমান সময়ে সবুজ প্রযুক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্মার্ট গ্রিড, ইলেকট্রিক ভেহিকলস এবং উন্নত রিসাইক্লিং প্রযুক্তি সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের প্রযুক্তি আরও উন্নত এবং সাশ্রয়ী হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশের জন্য ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্রাকৃতিক উৎস ধ্বংস না করে না। বরং পরিবেশ হতে প্রযুক্তিগত ভাবে প্রাকৃতিক উৎস আহরণের উপায় বের করে। গ্রিন টেকনোলজির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি পুনরায় ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই গ্রিন টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়।
পরিবেশগত সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি সবুজ প্রযুক্তি বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ কমায়, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব কমাতে সহায়তা করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। সবুজ প্রযুক্তির উন্নয়ন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ প্রদান করে এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে। এছাড়াও প্রযুক্তির মাধ্যমে শক্তির অপচয় কমানো যায়। যা বিশ্বব্যাপী দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক সাফল্য এনে দেয়। সবুজ প্রযুক্তি প্রবর্তনের জন্য প্রাথমিক খরচ সাধারণত বেশি থাকে যা অনেক সময় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু সবুজ প্রযুক্তি এখনও প্রযুক্তিগত সমস্যা এবং কার্যকারিতার অভাবের সম্মুখীন। সেগুলো আরও উন্নয়নের প্রয়োজন।
এ সকল সমস্যা উত্তরণ করে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তিকে জীববৈচিত্রের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারলে তা হবে সমগ্র বিশ্বের মানবজাতি সহ প্রাণীকুলের জন্য বিশেষ এক আশীর্বাদস্বরূপ। সবুজ প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং সম্ভাবনাময়। এটি শক্তি ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, শহুরে উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে। প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং নতুন উদ্ভাবন এই খাতের ভবিষ্যৎকে আরও উন্নত এবং উৎপাদনশীল হিসেবে গড়ে তুলবে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি আমাদের পৃথিবীকে আরও নিরাপদ ও টেকসই করে তুলতে সাহায্য করবে।
লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা