ডার্ক মোড
Wednesday, 24 September 2025
ePaper   
Logo
তারুণ্যের দিশেহারা ভবিষ্যৎ: নতুন সরকার কি জ্বালাতে পারবে ভরসার আলো

তারুণ্যের দিশেহারা ভবিষ্যৎ: নতুন সরকার কি জ্বালাতে পারবে ভরসার আলো


আবুবকর হানিপ
দিনকয়েক আগে ফেসবুকে একটি স্ক্রিনশটসহ পোস্টে চোখ আটকে যায়। সেখানে এক ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশি লিখেছেন, তিনি ১২ ঘণ্টা উবার চালিয়ে আয় করেছেন ১৬৯ ইউরো—বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২১ হাজার টাকা। এই আয়ে তিনি সন্তুষ্ট এবং জানিয়েছেন—এ জন্যই তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে এসেছেন। কারণ, তাঁর বিশ্বাস, দেশে থাকলে এক মাসেও এই ২১ হাজার টাকা আয় করতে তাঁকে হিমশিম খেতে হতো।

তাঁর এই বক্তব্যে সন্দেহ নেই, বাস্তবতার প্রতিফলন আছে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে বিদেশযাত্রা নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। অথচ ওই যুবকের কাছে মনে হয়েছে, এভাবেই যেন তাঁর জীবনের সব হিসাব মিলে গেছে। বাস্তব কি সত্যিই তাই? নিশ্চয়ই না। বরং এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিদেশযাত্রা নিরুৎসাহিত করাই শ্রেয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের যুবসমাজ করবে কী? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও তারা কাজ পাচ্ছে না। আর পেলেও সেটি তাদের যোগ্যতার তুলনায় অনেক কম মানের, আয়ও সামান্য। তাই ফ্রান্সে ১২ ঘণ্টা খেটে ১৬৯ ইউরো কামানোই ওই যুবকের কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন মনে হচ্ছে। অথচ সেটি আসলে ওই দেশের ন্যূনতম মজুরি মাত্র।

এরপরও সবাই বিদেশেই যেতে চায়। সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ’-এর তৃতীয় সিরিজের গবেষণা প্রতিবেদনে নানা শ্রেণি-পেশার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩ হাজার ৮১ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকারভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও চাকরির প্রয়োজনে বিদেশে যেতে চায় বাংলাদেশের ৫৫ শতাংশ তরুণ। চিন্তা করা যায়, একটি দেশের ৫৫ শতাংশ তরুণ বিদেশে চলে যেতে চায়! ওই গবেষণাতেই দেখা গেছে, দেশে বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ৪২ শতাংশ তরুণ। ফলাফল কী? কর্মহীন ও উচ্চশিক্ষিত, স্বল্প বা আধা শিক্ষিত এই বিপুল তরুণ জনশক্তি কোথাও কাজে লাগতে না পারায় তাদেরই ৩২ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সে অপরাধের তুলনায় সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে গিয়ে কামাইয়ের চেষ্টা অবশ্য কমই উদ্বেগের।
এখানে আমি আরেকটি প্রশ্ন তুলতে চাই। আমাদের তারুণ্য যখন বিদেশে যায়, তারা কি শুধু উবার চালাবে, অথবা হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করে বাংলাদেশের তুলনায় কিছু বেশি আয়ের গর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেবে? নিশ্চয়ই নয়! তাহলে তারা করবে কী? পড়াশোনা শেষে বাংলাদেশের তরুণদের গন্তব্য কোথায় হবে? তাদের ভবিষ্যৎইবা কীভাবে নির্ধারিত হবে? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়, আর সেখান থেকেই চোখে পড়ল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালে পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদন। এতে দেখানো হচ্ছে, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই স্রেফ নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণেও নেই। ছেলেদের চেয়ে এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার দেড় গুণের বেশি মেয়েদের মধ্যে। সে হার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
তারুণ্য নিয়ে আমাদের গর্ব আছে। সব আন্দোলন-সংগ্রামে তারুণ্যই সবচেয়ে বেশি শক্তি জুগিয়েছে। আর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের গর্ব তো আমরা সারাক্ষণই করি। শিক্ষায় মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া নিয়েও গর্ব কম নয়। কিন্তু দেশের তরুণ শ্রেণি যে বেকারত্বের ভারে ন্যুব্জ এবং ক্রমাগত অন্যায়-অপরাধে ঝুঁকে পড়ছে, তার প্রমাণ হিসেবে ওপরের পরিসংখ্যানগুলোই কি যথেষ্ট নয়? এসব দেখে আর গর্বের লেশমাত্র থাকে না!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না? কেন তারা থেকে যাচ্ছে বেকার বা আংশিক বেকার? কেন নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও তারা কর্মহীন হয়ে বসে আছে? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চোখ ফেলতে হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকেই। একে ত্রুটি বলতে চাই না, তবে এটুকু বলতে চাই—আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন কিছু ঘাটতি আছে, যা এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকার তৈরির জন্য দায়ী। সেই ঘাটতি কী? আমার ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি—কর্মমুখী শিক্ষার অভাবই এ বেকারত্বের মূল কারণ।
অনেকেই বলতে পারেন কর্মমুখী শিক্ষা তো হচ্ছেই। আমাদের কারিগরি শিক্ষা আছে, ভোকেশনাল ট্রেনিং রয়েছে। কিন্তু আমি বলব, সেটা মোটেও যথেষ্ট নয়। ওপরের পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। আমাদের এখন উচিত সাধারণ শিক্ষাক্রমেই পরিবর্তন আনা। অর্থাৎ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই এই দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। যাতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েই, কিংবা পেরোনোর আগেই কোনো একটি কাজে যোগ দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকেই তারা শিখবে কর্মক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো।
বর্তমান সরকারের কাছে এই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি। বলছি, বিষয়টি নিয়ে আর বসে থাকার সময় নেই। দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম এখন সময়ের প্রয়োজন। আপনার শিক্ষার্থী যদি স্রেফ একটি ডিপ্লোমা কিংবা সনদ হাতে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসে, তারা সেই সনদ দেখিয়ে চাকরি পাবে না। এ যুগে কেউ পায় না। যেকোনো নিয়োগদাতা প্রথমেই জানতে চায়—এই চাকরি প্রার্থীটি কী পারে? কোন কাজটিতে তার দক্ষতা রয়েছে? কাজে যোগ দিয়েই সে কি সক্ষম প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো অবদান রাখতে? লেখাপড়ার ফাঁকে এই দক্ষতা অর্জন হয়তো সম্ভব। কিন্তু তার প্রয়োজন কেন—বিশ্ববিদ্যালয়ই তো পারে ক্লাসরুম থেকে এই দক্ষতাটুকু শিখিয়ে দিতে। সে জন্যই পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাক্রমে। পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে।
যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে আমরা এই পদ্ধতির প্রয়োগে সফলতা পাচ্ছি। এখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুম থেকে বিষয়ভিত্তিক গভীর আলোচনা যেমন করতে পারছে, তেমনি ল্যাবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিষয়-সংশ্লিষ্ট দক্ষতাও পাচ্ছে হাতে-কলমে। আমাদের শিক্ষকেরা একাধারে স্কলার এবং ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট। বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিতে সক্রিয় রয়েছেন, এমন স্কলাররাই আসছেন ক্লাসরুমে। ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁদের গড় অভিজ্ঞতা ১৮ বছর। ফলে তাঁরা তাঁদের স্কলারি জ্ঞান ও যোগ্যতার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নিত্যদিনের দক্ষতাও শেয়ার করতে পারছেন ক্লাসরুমে। শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে ইন্ডাস্ট্রির সবশেষ উৎকর্ষের তথ্য ও দক্ষতা। ক্লাসরুমটিই হয়ে উঠছে কর্মক্ষেত্রের রেপ্লিকা। এতে শিক্ষার্থীরা তৈরি হচ্ছে কর্মক্ষেত্রের উপযোগী হয়ে। এটি একটি ব্লেন্ডেড মডেল। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তৈরি হচ্ছে তাদের উন্নত ক্যারিয়ারের জন্যও। ডিগ্রি-স্কিল-ক্যারিয়ার—বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ট্রিপল মিশন মাথায় রেখেই এমন শিক্ষাপদ্ধতির নকশা তৈরি করা হয়েছে। এর সারকথা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা আর এন্ট্রি লেভেল জব খুঁজবে না। বরং তারা কাজ শুরুই করবে মিড কিংবা সিনিয়র পর্যায় থেকে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত ডিগ্রি ও স্কিল ব্যবহার করেই তারা এগিয়ে যাবে উন্নত ক্যারিয়ারের পথে।
বস্তুত এন্ট্রি লেভেলের কাজগুলো এখন আর নেই বললেই চলে। জেনেরেটিভ এআইয়ের দখলে চলে গেছে সেসব কাজ। স্রেফ এআই এজেন্ট ব্যবহার করে কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রাথমিক ধাপের সাধারণ কাজ আর ব্যক্তি-মানুষের জন্য থাকছে না। তাহলে মিড বা সিনিয়র পর্যায়ের কাজগুলোই ভরসা। আর সে কারণেই এই বিশেষ মডেল কার্যকর হয়ে উঠছে।
এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে যে কাজটি করতে হয়েছে তা হচ্ছে, শিক্ষাক্রমে কিছু পরিবর্তন আনা। সময়ের সবচেয়ে উপযোগী ও আগামী দিনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। অর্থাৎ দক্ষতা তৈরির বিষয় ও টুলসগুলোকে, কিংবা ল্যাবভিত্তিক কার্যক্রমগুলোই পাঠ্যসূচির অংশ করে নেওয়া। এতে বিভিন্ন বিষয় ও টুলসভিত্তিক ল্যাব গ্রেডেড অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে শিক্ষার্থীরা চর্চা করছে এবং শিখছে সরাসরি হাতে-কলমে। পদ্ধতিটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি মডেল হিসেবেই আজ স্বীকৃত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ডব্লিউইউএসটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই মডেল ব্যবহার করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৭টি পাবলিক, ১১৬টি প্রাইভেট ও ৩টি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি রয়েছে। এরা সবাই চাইলে এই মডেল ব্যবহার করতে পারে।
 আমি আমার দুই যুগের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের জন্য দক্ষতা অর্জনের শীর্ষ খাতগুলো চিহ্নিত করতে পারি। যার প্রথমেই জোর দেব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিষয়ক কোর্স চালু করার ওপর। এআইয়ের কারণে সৃষ্ট ধাক্কা সামলাতে শিক্ষার্থীদের এআইয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারই শিখতে হবে সবার আগে। এ ছাড়া অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আরও ১৫টি প্রধান খাত হতে পারে

১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)–এজেন্টিক এআই, কম্পিউটার ভিশন, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং
২. মেশিন লার্নিং (ML) ও ডিপ লার্নিং–প্রেডিক্টিভ অ্যানালাইসিস, অটোমেশন মডেল
৩. ডেটা সায়েন্স ও বিগ ডেটা–ডেটা অ্যানালাইসিস, ডেটা ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজনেস ইন্টেলিজেন্স
৪. তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট–প্রোগ্রামিং, সাইবার সিকিউরিটি
৫. ক্লাউড কম্পিউটিং ও ডেভঅপস–AWS, Azure, Google Cloud, সিস্টেম অটোমেশন
৬. ফিনটেক (FinTech) ও ডিজিটাল ফাইন্যান্স–মোবাইল ব্যাংকিং, ব্লকচেইন, ডিজিটাল পেমেন্ট সল্যুশন
৭. ডিজিটাল মার্কেটিং ও কনটেন্ট ক্রিয়েশন–ই-কমার্স, সোশ্যাল মিডিয়া, গ্রাফিকস
৮. হেলথকেয়ার ও মেডিকেল টেকনোলজি–মেডিকেল সহকারী, টেলিমেডিসিন
৯. গ্রিন এনার্জি ও এনভায়রনমেন্টাল টেকনোলজি–সোলার, উইন্ড ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
১০. কনস্ট্রাকশন ও ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি–সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং টেস্টিং, নবায়নযোগ্য শক্তি
১১. কৃষিপ্রযুক্তি–স্মার্ট ফার্মিং, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ
১২. ক্রিয়েটিভ মিডিয়া ও বিনোদন শিল্প–চলচ্চিত্র, গেম ডেভেলপমেন্ট, মিউজিক টেকনোলজি
১৩. বিজনেস ও প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট–উদ্যোক্তা উন্নয়ন, ফ্রিল্যান্সিং মডেল
১৪. টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসের হাই-টেক সেক্টর–অটোমেশন ও ডিজাইন টেকনোলজি
১৫. ট্রান্সপোর্ট ও লজিস্টিক—স্মার্ট সাপ্লাই চেইন, ডেলিভারি ম্যানেজমেন্ট

ওপরের সবগুলো বিষয় এখন সময়ের প্রয়োজনে শিখতে হবে। তবে সবার আগে এআইয়ের কথা কেন বলছি, সেটার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি শিক্ষা—এই দুইয়ে মিলে বিশ্ব আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অথচ আমরা সে গতিতে এগোতে পারিনি, এটা বলাই বাহুল্য। এত দিন আমরা পিছিয়ে থেকেও ধীরে ধীরে এগিয়েছি, কিন্তু সামনে আর সেটা সম্ভব নয়। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই পুরো খেলার ধরনটাই বদলে দিচ্ছে।

ভাবুন, ‘জাভা’ একটি জনপ্রিয় প্রোগ্রামিং ভাষা। একে শিখতে যেমন সময় লাগে, তেমনি এর ব্যবহার করে কাজ করতে গেলেও আগে অনেক সময় লাগত। শুধু একটি বেসলাইন তৈরি করতেই দীর্ঘ সময় চলে যেত, অনেক মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হতো। কিন্তু এখন এআই এজেন্ট সবকিছুই করে দিচ্ছে। ফলে সময় যেমন লাগছে না, তেমনি প্রয়োজন পড়ছে না এত মানুষেরও। এতে কিছু মানুষ কাজ হারাচ্ছে। এত দিন একটি দক্ষতা দিয়েই লাখ লাখ মানুষ কাজ পেয়েছে, এখন সেই সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে এআই।
এইভাবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এআই তার প্রভাব বিস্তার করছে। কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে, আর বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে শুরু থেকেই কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্য ও উচ্চস্তরের কাজে দক্ষ হতে হবে। তাই এখনই সময় এজেন্টিক এআইকে ভালোভাবে বোঝা এবং শেখার। কারণ, যারা এটা রপ্ত করতে পারবে, তারাই ভবিষ্যতে এগিয়ে থাকবে।
এজেন্টিক এআই মানে হলো এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা নিজে থেকে কাজ করতে পারে। এটি নিজের লক্ষ্য ঠিক করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সব সময় মানুষের সাহায্য ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে পারে।
নিবন্ধের শুরুতে আমি দুটি প্রশ্ন রেখেছিলাম—আমাদের তরুণেরা কি বিদেশে গিয়ে শুধু উবার চালাবে? তারা কি কেবল অদক্ষ কাজই করবে, নাকি কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াবে? উত্তর একটাই—নিশ্চয়ই না। ওপরের কর্মপরিকল্পনা থেকেই তা পরিষ্কার। আমরা চাই আমাদের তরুণেরা বিদেশে যাবে তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতা নিয়ে, বড় বড় কাজে অবদান রাখার জন্য। আবার তারা চাইলে দেশে বসেও শেষ করতে পারবে আন্তর্জাতিক প্রকল্প। এতে তারা যুক্ত হতে পারবে গ্লোবাল জব পোর্টাল বা আউটসোর্সিংয়ের সুবিধার সঙ্গে। অনলাইনে তারা খুঁজে নেবে আন্তর্জাতিক বাজারের কাজ। এ জন্য অনলাইনে আন্তর্জাতিক ডিগ্রি বা ভেন্ডরসার্টিফিকেশন সম্পন্ন করে নিজেদের আরও প্রস্তুত করে তুলতে পারে।
অন-ক্যাম্পাসের পাশাপাশি ডব্লিউইউএসটি-এর গ্লোবাল ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ডিগ্রি দিচ্ছে, যা বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে অর্জন করা সম্ভব। শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে বসেই অর্জন করতে পারে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি। এসব অনলাইন ডিগ্রি সিঙ্ক্রোনাস ও অ্যাসিঙ্ক্রোনাস উভয় মডেলে তৈরি, যাতে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে সরাসরি ল্যাবে বসে কাজ করার অভিজ্ঞতা কিংবা শেখার পরিবেশ অনুভব করতে এবং শিখতে পারে। এভাবে, যখন প্রতিটি শিক্ষার্থীর ঝুলিতে ডিগ্রির পাশাপাশি স্কিল যুক্ত হবে, তখনই সেটাই তাদের উন্নত ক্যারিয়ারের পথে এগিয়ে নেবে।
নতুন সরকার কি জ্বালাতে পারবে ভরসার আলো
তা ছাড়া, আমাদের তরুণেরা স্রেফ কাজই খুঁজবে না, দক্ষতা নিয়ে তারা নিজেরাই হয়ে উঠবে একেকজন উদ্যোক্তা। তারা কাজ খুঁজবে না বরং তারা কাজ দেবে। সে ক্ষেত্রেও রয়েছে ডব্লিউইউএসটির বিশেষ উদ্যোগ—বিজনেস ইনোভেশন ও ইনকিউবেশন সেন্টার। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার উৎসাহ জোগানো হয়। আর শুধু স্বপ্নই দেখানো হয় না, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যাতে উদ্যোক্তা হতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহেও থাকছে তহবিল। যখন দক্ষ কোনো হাতে মূলধন সরবরাহ করা সম্ভব হবে, তখন সে উদ্যোগ সাফল্যে রূপ নেবেই। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে।
এখানে প্রস্তাব হিসেবে সরকারের কাছে পরামর্শ থাকবে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম লক্ষ্যস্থল হিসেবে বেছে নেওয়ার। কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৪ লাখ ২৫ হাজার ৮৩২ জন শিক্ষার্থী (সূত্র: বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইট)। এবং আমি ধারণা করি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ হাতে বের হয়ে এরাই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে। কারণ, কর্মক্ষেত্রে তাদের যেসব জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন, তা তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পায় না। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকেই উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় অ্যাপ্লায়েড ইউনিভার্সিটিতে পরিণত করা সম্ভব। তাতে সবচেয়ে অ্যাফোর্ডেবল ও অ্যাকসেসবল বিশ্ববিদ্যালয়টিই একসময় হয়ে উঠতে পারবে দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ গড়ে তোলার সূতিকাগার, যা তাদের ক্যারিয়ারের পথেও উপযোগী হবে, তাহলে ভবিষ্যতের যে বাংলাদেশ আমরা চাই, সেদিকেই আমরা ধাবিত হতে পারব।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বলব, ডিগ্রি অর্জনের পথেই আরও যে দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে, ছাত্রাবস্থাতেই নিজের ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড তৈরি করা। সোশ্যাল মিডিয়া এখানে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেই সব বিষয়ে আপনার এক্সপারটিজ আছে, সেগুলোর ওপরে নিয়মিত মতামত দিন, পডকাস্ট বা ভিডিও পোস্ট করুন কিংবা লেখালেখি করুন; মনে রাখবেন, আপনার লিংকডইন প্রোফাইলই আপনাকে নিয়োগকর্তার কাছে পরিচিত করে তোলার সেরা মাধ্যম।
সবশেষে বলতে চাই, ইংরেজি শিক্ষা ও যোগাযোগ দক্ষতার কথা। মনে রাখবেন, আপনার প্রতিযোগিতা আর শুধু উপজেলা, জেলা কিংবা দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। আজকের বিশ্বে আপনার প্রতিযোগিতা গোটা পৃথিবীর সঙ্গে। পৃথিবী আপনার কর্মক্ষেত্র, আর আপনাকে প্রমাণ রাখতে হবে সেই বৈশ্বিক মঞ্চেই।
তাই বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে হলে, বিশ্ববাজার থেকে কাজ অর্জন করতে হলে, ইংরেজির ওপর দক্ষতা গড়তেই হবে। শুধু তা-ই নয়, আপনাকে দক্ষ হতে হবে যোগাযোগ কৌশলেও। কাজের ধরন ও বর্ণনা ঠিকভাবে বোঝা এবং ডেলিভারির সময় তা ক্লায়েন্টকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বিজনেস ইংরেজি অপরিহার্য।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি—বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা কারিকুলামে এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেতে হবে।
ভাবুন তো, প্রতিটি শিক্ষার্থী যদি সাবলীলভাবে কনভারসেশনাল ইংরেজি বলতে পারে, আর ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইংরেজি আয়ত্ত করতে পারে—তাহলে তাদের অগ্রযাত্রা রুখে দেবে কে? কেউ না। তখন আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই হবে সেই আত্মবিশ্বাসী প্রজন্ম, যারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে।
তারুণ্যের মধ্যে আছে অশেষ শক্তি, অগণিত স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎকে পাল্টে দেওয়ার সামর্থ্য। এখন প্রয়োজন শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা আর বিশ্বাস। নতুন সরকার সেই ভরসার আলো জ্বালালে, তরুণেরাই হয়ে উঠবে আগামী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পিপলএনটেক

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন