
‘এক্সট্রা ক্লাসে’র অপেক্ষায় থেকে হারিয়ে গেল ওরা
নিয়মিত ক্লাস ছুটি ও এক্সট্রা ক্লাস শুরুর মাঝের সময়টুকুতে অনেক শিক্ষার্থীই টিফিন খাচ্ছিল। অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিমান দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগে তৃতীয় শ্রেণির ক্লাউড সেকশনের আফিয়া উম্মে মরিয়মও ভাত খাচ্ছিল।
শুধু আফিয়া নয়, মাইলস্টোন স্কুল কর্তৃপক্ষের এই ‘এক্সট্রা ক্লাসে’র অপেক্ষা করতে গিয়ে অনেক শিশুকেই সেদিন দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির মুখে পড়তে হয়েছে।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়তে শিক্ষার্থীদের মোটা অংকের টাকা গুনতে হয়। প্রতিষ্ঠানটির ইংলিশ ভারসনের ষষ্ঠ শ্রেণির নিহত শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ ছামীমের পরিবারের দাবি, ‘এখানে ভর্তিতে লাগে ৫০ হাজার টাকা, আর বেতন দিতে হয় চার হাজার ২০০ টাকা’। এমন খরুচে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এত টাকা দেওয়ার পরও কেন সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ‘এক্সট্রা ক্লাস’ নামের কোচিংয়ের চাপে পড়তে হয় (এই কোচিংয়ের জন্য আবার উল্লিখিত শ্রেণিতে ছয় হাজার টাকা বাড়তি দিতে হয়), তা নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাসের পরও এক্সট্রা ক্লাসে অংশ নেওয়ার বিষয়ে রয়েছে কড়া নির্দেশনা। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থী যদি নিয়মিত ক্লাস শেষ করে এক্সট্রা ক্লাসে (কোচিং) অংশ না নেয়, তাহলে সেই শিক্ষার্থীর অভিভাবককে স্কুল কর্তৃপক্ষ বরাবর অঙ্গীকারনামা দিতে হয়।
‘আমাদের জোরপূর্বক কোচিং করতে বাধ্য করেন টিচাররা, নয়তো ফেইল করানোর ভয় দেখান। এমনকি অঙ্গীকারনামায় বলা হয়, যদি আমরা কোচিং ক্লাস না করি তাহলে রেজাল্ট খারাপ হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে’, বলছিল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই স্কুলেরই ক্লাস থ্রির একজন শিক্ষার্থী।
কেন এত ছোট্ট শিক্ষার্থীদের ওপর কোচিংয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া- এমন প্রশ্ন ছুড়ে একজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই স্কুলে তার দুই সন্তান পড়াশোনা করছে।
তিনি বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ জমি কেনা থেকে শুরু করে ভবন নির্মাণ, সব ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। বেতনের সঙ্গে আমাদের কাছ থেকে বাড়তি তিন হাজার টাকা নিয়েছে। বাচ্চা পড়াতে হবে বলে আমরা নিরুপায় হয়ে সব মুখ বুজে সহ্য করেছি। ’
এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বাংলা মিডিয়ামের সহকারী শিক্ষক মো. কাশরুজ্জামান ও শিক্ষিকা ফেরদৌস মিলির সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। দুজনের কথায়ই বেশ অসামঞ্জস্যতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে।
শিক্ষক কাশরুজ্জামান বলেন, ‘ক্লাস শেষে কোনো কোচিং করানো হয় না স্কুলে। ’ তখন প্রতিবেদক তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে দুপুর ১টার দিকে ছুটি হওয়ার পরও কেন ক্লাসে ছিল শিক্ষার্থীরা। ’ জবাবে এই শিক্ষক বলেন, ‘স্বল্প কিছু শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবকের জন্য অপেক্ষা করছিল। ’ ‘তবে সেটি ক্লাসরুমে কেন’, প্রশ্ন করা হলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি এই শিক্ষক।
‘কতজন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল’, বিষয়টি মুখস্ত আছে বলে এক পর্যায়ে দাবি করেন কাশরুজ্জামান। তখন তার কাছে নিচতলার শ্রেণিকক্ষে অর্থাৎ দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কতজন শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল জানতে চাইলে তিনি অনুমান করে বলেন, ‘সেদিন সর্বসাকুল্যে ৩০ জন শিক্ষার্থী নিচতলার তিনটি শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত ছিল’। ‘তাহলে নিহতের সংখ্যাই যেখানে ৩১, সেখানে এই সংখ্যা কীভাবে হতে পারে’, জানতে চাইলে এই শিক্ষক আর কোনো জবাব দিতে পারেননি।
কথা বলে ফেরদৌস মিলি নামে শিক্ষার্থীরা স্কুল শেষেও কেন অপেক্ষা করছিল জানতে চাইলে তিনিও কোচিংয়ের বিষয়টি এড়িয়ে যান। তারপর এক পর্যায়ে কোচিংয়ের কথা স্বীকার করলেও এটি শিক্ষার্থীদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন। সেদিনের উপস্থিতির তথ্য চাওয়া হলে তিনি জানান, সেটি নিরূপণে কাজ করছেন তারা। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির তথ্য তো প্রতিদিনই রেকর্ড (নথিভুক্ত) হয়, তাহলে নিরূপণের কথা কেন আসছে, জানতে চাইলে এই শিক্ষিকা বলেন, ‘আমরা সবই জানি কতজন নিহত কতজন আহত। ’ তাৎক্ষণিক সে সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা নানা সংকটে আছি, সবকিছু নিয়েই কাজ করছি। সময়মতো সবই জানাবো। ’
এ বিষয়ে আরেক শিক্ষক হুমায়ন রশিদের (চতুর্থ শ্রেণির ফরম শিক্ষক) সঙ্গে যোগাযোগ করলে সাংবাদিক পরিচয় শুনেই চটে যান তিনি। রশিদ উল্টো কৈফিয়ত চান, অনুমতি না নিয়ে কেন তাকে ফোনকল করা হলো। এরপর তাকে পরবর্তী সময়ে কল না করারও কড়া বার্তা দেন তিনি।
এদিকে একাধিকবার ফোনকল ও ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলমের।
- ‘বাংলাদেশের এডুকেশন অ্যাক্ট ২০১৬’ এবং শিক্ষা বিভাগের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলের সময় বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসে অংশ নিতে বলা যায় না। স্কুলে এক্সট্রা ক্লাস দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বেচ্ছামূলক এবং অবাধ থাকতে হবে।
তবে অনেক স্কুলে শিক্ষকদের চাপের কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার চাপ তৈরি হয়, যা আইনগতভাবে বেআইনি ও শিক্ষার্থীর অধিকার লঙ্ঘন।
শৈশব হয়ে পড়ছে ক্লান্তিকর
‘আমরা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে ছোট্ট শিশুরাও এক্সট্রা ক্লাস নামের কোচিং বাণিজ্যের শিকার। এতে বলি হচ্ছে তাদের শৈশব, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানসিক বিকাশ। কেন এত লম্বা সময় পর ক্লাস করার পরও আবার এক্সট্রা ক্লাস করতে হবে’, বলছিলেন শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানদের ছোট্ট বয়সেই ক্লান্তিকর শৈশব চাপিয়ে দিচ্ছি। শিশুদের জীবনের স্বাভাবিক ঘুম, খাওয়া, বিশ্রাম ও খেলার সময় কেড়ে নিয়ে সেখানে শুধু বই আর কোচিং ক্লাসের বোঝা চাপাচ্ছি। দিয়াবাড়ির ঘটনায় আমরা শোকাহত। তবে তাতেও কি আমাদের বিবেক জাগ্রত হবে—কেন ক্লাসের পর শিক্ষার্থীদের এক্সট্রা ক্লাসের জন্য স্কুলে বসে থাকতে হবে। কোনো শিক্ষার্থীর কোনো বিশেষ বিষয়ে দুর্বলতা থাকলে তা শ্রেণিকক্ষেই সমাধান করা সম্ভব, কিন্তু আমরা তো শিক্ষাবাণিজ্য করতে মত্ত’।
নন একাডেমিক অ্যাক্টিভিজম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা
২০০৯ সালে প্রকাশিত ইউনেস্কোর ‘কনফ্রন্টিং দ্য শ্যাডো এডুকেশন সিস্টেম’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, শিক্ষার্থীরা স্কুল শেষে দীর্ঘ সময় টিউশন বা কোচিংয়ে ব্যয় করছে, যার ফলে তারা যথাযথ বিশ্রাম, ঘুম এবং খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা ‘নন একাডেমিক অ্যাক্টিভিজম’—যেমন বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, সামাজিক মেলামেশা ও সৃজনশীলতায় অংশগ্রহণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
গবেষণায় এ চর্চাকে ‘ছায়া শিক্ষা ব্যবস্থা’ বলে অভিহিত করা হয়, যেখানে সরকারি শিক্ষাপদ্ধতির বাইরের একটি চাপ ও বাণিজ্যিক কাঠামো শিশুদের মনোজগতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে।
রিপোর্টটি ইউনেস্কোর শিক্ষা পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউট (IIEP) থেকে প্রকাশিত হয়।
‘স্প্রিং এডুকেশন জার্নাল ২০২০’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের সময় সংকটে পড়তে হচ্ছে। কোচিং ও বাড়ির কাজের কারণে তারা বিশ্রাম, খেলাধুলা এমনকি পরিবারের সঙ্গেও পর্যাপ্ত সময় কাটাতে পারছে না।