
সত্যের মুখে মুখোশ পরানোর অভিনব শিল্প
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
এক সময়ের বিপ্লবী নেতারা ছিলেন রাজপথের সাহসী কণ্ঠস্বর, হাতে মাইক, মুখে স্লোগান—“এই অন্যায় মানি না!”। আজকের নেতা? তিনি ব্যস্ত কনট্রাক্টের টেন্ডার নিয়ে, এক হাতে বিল পাশ, আরেক হাতে বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের ঘড়ি ঠিক করছেন। বিপ্লব এখন আর রাজপথে হয় না, হয় টিকটক বা ফেসবুক লাইভে—পেছনে দুই ডজন কর্মী, সামনে হালকা ফিল্টার!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আদর্শ খোঁজার চেষ্টা করা মানে সাফারি পার্কে ডাইনোসর খোঁজার মতো—তত্ত্বে আছে, বাস্তবে নিখোঁজ। এক সময় ছাত্র রাজনীতি মানেই ছিল চিন্তার লড়াই, গণআন্দোলনের সূতিকাগার। এখন? হলে কে কোন কক্ষ দখল রাখবে, কে ক্যান্টিনে কত টাকা ‘তুলবে’—এসবই নীতির সংজ্ঞা। বই পড়ার বদলে চলে দলীয় ব্যানারে ‘ভবিষ্যৎ ভবিষ্যদ্বাণী’: "আজ কক্ষ দখল, কাল সিন্ডিকেট, পরশু প্রকল্প কমিশন।"
একটা সময় ছিল, যখন নেতা হতেন ত্যাগের প্রতীক। এখন তিনি ‘পিআর মেশিন’—দলীয় ফেস্টুনে হাসি দেন, পেছনে ঠিকাদারি বিল হাসিয়ে তোলেন। স্লোগান দেন—“জনগণের পাশে আছি”, বাস্তবে জনগণের জমির পাশে ফ্ল্যাট বানান। এইসব বিপ্লবীরা রাতে মিটিং করেন ‘আদর্শ’ নিয়ে, আর দিনে ব্যস্ত থাকেন ঠিকাদারির ডিও লেটার বিতরণে।
ছাত্র রাজনীতি তো এখন একপ্রকার স্টার্টআপ মডেল—প্রথমে অনুগত্য, পরে হল দখল, তারপর উপজেলা প্রজেক্টের ভাগ। বই নয়, বাইকার দল নিয়ে ক্যাম্পাসে ‘শোডাউন’ই এখন নেতা হবার প্রধান যোগ্যতা। “লিডার” শব্দটি আজকাল আর নীতির সঙ্গে যায় না, বরং যায় ‘লিডারশিপ চেইন’ বা ‘ঘাড়ে ঝোলানো গোল্ড প্লেটেড আইডি কার্ড’-এর সঙ্গে।
আদর্শ? ওটা এখন ওয়েবিনারের বিষয়বস্তু। মাঠে ‘আদর্শবাদী’ পরিচয় দিলে এখনকার কর্মীরা জিজ্ঞেস করে—“ভাই, ঠিকাদারি পারো না?” আদর্শের বদলে চলছে সুবিধাবাদ, ত্যাগের বদলে লভ্যাংশের ভাগবাটোয়ারা। এক সময় যে নেতারা রাষ্ট্রকে ভয় পেতেন না, এখন তাঁরাই থানার ওসির সাথে চা খেয়ে থানার ‘ফাইল ম্যানেজ’ করেন। জনগণের বিপ্লবী এখন জনগণের ভয়!
রাজনীতি এখন এতটাই অভিনব শিল্পে পরিণত হয়েছে, যেখানে সত্যকে ঢেকে দেওয়ার জন্য একটি মাস্ক যথেষ্ট নয়—দরকার বহুমুখী মুখোশ। আদর্শ, সেবা, নেতৃত্ব—সব শব্দই এখন সাইনবোর্ডে, কাজ চলে কমিশন, চাঁদা আর কোটার হিসাব নিয়ে। কোন নেতা কতটা ‘আয়’ করছে—সেটাই এখন তার যোগ্যতার সার্টিফিকেট।
আরেকটু গভীরে গেলে দেখা যাবে, বিপ্লব এখন একধরনের ‘ক্যারিয়ার অপশন’। ইন্টার্নশিপ শুরু ছাত্র রাজনীতি থেকে, তারপর সিনিয়র ভাইদের ফাইল বহন, মাঝখানে কন্ট্রাক্টের চা-নাশতা, আর শেষে বিলাসবহুল গাড়ি। বইপত্র না পড়লেও সমস্যা নেই, ‘চাঁদা কোটা’ পূরণ হলে মন্ত্রীর সাথে সেলফি পাবেন নিশ্চয়!
এই রাজনৈতিক ডিএনএ এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে তরুণরা রাজনীতিকে দেখে ‘ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’ হিসেবে। যারা এখনো আদর্শের কথা বলে, তাদের বলা হয় ‘সিরিয়াসলি নেয়া যায় না’। কারণ আদর্শে পকেট গরম হয় না। ফলে, রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন এক সার্কাস, যেখানে মুখোশ পরেই নামতে হয় মঞ্চে—সত্য বললেই ‘পিছনে হাত’ হয়ে যায়।
এত কিছুর মাঝে আশার আলো? খুব ক্ষীণ। আদর্শিক, দক্ষ, সৎ নেতৃত্ব এখন লুপে ঢুকে গেছে—দলীয় কোন্দল আর সিন্ডিকেটের চক্রব্যূহে। ফলে শিক্ষিত, নীতিবান তরুণরা রাজনীতি ছেড়ে হেলথ কেয়ার স্কলারশিপ কিংবা ইউরোপিয়ান গ্রিন কার্ডের খোঁজে ব্যস্ত।
সত্যি বলতে, আজকাল "বিপ্লব" শব্দটা শুনলে মানুষ হাসে। কারণ বিপ্লব এখন ইতিহাসের বিষয় নয়, মিমের বিষয়। এটা আর মানুষকে জাগায় না, বরং মানুষ প্রশ্ন করে—“এই বিপ্লবী এখন কোন ফ্ল্যাটে থাকে?”। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি রাজনৈতিক আদর্শ বলতে শুধু চাঁদাবাজি আর ডিও লেটার বোঝে, তাহলে এ দায় আমাদেরই।
তাই এখন সময় সত্যকে উদ্ধার করার, মুখোশ টেনে ফেলার। বিপ্লব যদি ফিরে আসতে চায়, তবে তাকে ফিরতে হবে নেতৃত্বে আদর্শ, কাজে স্বচ্ছতা, আর চরিত্রে সাহস নিয়ে। নইলে রাজনীতি কেবল ‘কমেডি নাটক’, আর আমরা দর্শক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তক
সভাপতি - কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল - fokoruddincse@gmail.com