ডার্ক মোড
Saturday, 21 December 2024
ePaper   
Logo
শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে আদানি পাওয়ারের চুক্তি পর্যালোচনায় বাংলাদেশের চাপ

শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে আদানি পাওয়ারের চুক্তি পর্যালোচনায় বাংলাদেশের চাপ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

নয়াদিল্লির কাছ থেকে পাওয়া কর ছাড় সুবিধা গোপন করে ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ার মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এই চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশাপ্রকাশ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

২০১৭ সালে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানি আদানি পাওয়ারের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় অবস্থিত কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে ২৫ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নথিপত্র, উভয় পক্ষের চিঠি পর্যালোচনা এবং পিডিবির ছয় কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রয়টার্স বলেছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনও ধরনের দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই চুক্তিটি করেছিলেন এবং এর ব্যয় বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লা বিদ্যুৎ চুক্তির তুলনায় অনেক বেশি। যে কারণে চুক্তিটি নিয়ে পুনরায় আলোচনার প্রত্যাশা করছে ঢাকা।

গত বছরের জুলাইয়ে বিদ্যুতের সরবরাহ শুরু হওয়ার পর থেকে আদানি পাওয়ারের অর্থ পরিশোধে পিছিয়ে রয়েছে ঢাকা। বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কাছে আদানি পাওয়ার কয়েক মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে। যদিও বকেয়ার সঠিক পরিমাণ নিয়ে উভয়পক্ষের মাঝে বিরোধ রয়েছে।

জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রয়টার্সকে বলেছেন, আদানির সরবরাহ ছাড়াই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে, যদিও দেশের অভ্যন্তরীণ সব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালু নেই।

গত আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যু হন শেখ হাসিনা; তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেন সমালোচকরা। গত দুই দশকের বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। শেখ হাসিনার পতনের পর গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

কর ছাড় নিয়ে আদানির চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে রয়টার্স। ব্রিটিশ এই বার্তা সংস্থা ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তিটি নিয়ে পুনরায় আলোচনা করার জন্য বাংলাদেশের পরিকল্পনা সম্পর্কেও বিস্তারিত প্রকাশ করছে। রয়টার্স বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে গত নভেম্বরে ২৬৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেওয়ার এক মামলায় আদানি ও তার সাত নির্বাহীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মার্কিন আদালতের এই ঘটনা বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তি পর্যালোচনায় আদানির ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশে আদানি পাওয়ারের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের অনিয়মের অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছে কোম্পানিটি। আদানি পাওয়ারের একজন মুখপাত্র রয়টার্সের করা প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তারা চুক্তির সমস্ত বাধ্যবাধকতা রক্ষা করেছেন এবং ঢাকা চুক্তি পর্যালোচনা করছে এমন কোনও ইঙ্গিত তাদের কাছে নেই। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কর সুবিধা ও অন্যান্য বিষয়ে তোলা অভিযোগের কোনও জবাব দেয়নি আদানি পাওয়ার।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রে ওঠা অভিযোগকে ‘‘ভিত্তিহীন’’ বলে দাবি করেছে আদানি গ্রুপ।

• কর ছাড়

আদানি পাওয়ারের গড্ডা প্ল্যান্টটি আমদানি করা কয়লা দিয়ে চলে এবং এই কেন্দ্রে উৎপাদিত পুরো বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করার কথা। কোম্পানিটি বলেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিটি ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির উদ্দেশ্যগুলোকে এগিয়ে নিতে আরও সহায়তা করছে। ২০১৯ সালে নয়াদিল্লি গড্ডার প্ল্যান্টটিকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ হিসাবে ঘোষণা করে। এর ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আয়কর এবং অন্যান্য শুল্ক ছাড়ের মতো প্রণোদনা পায়।

আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মাঝে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তি ও বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের করহার পরিবর্তন হলে সেই বিষয়ে বাংলাদেশকে দ্রুত অবহিত করতে হবে। একই সঙ্গে ভারত সরকারের কাছ থেকে ‘‘কর ছাড় সুবিধাও’’ দেওয়ার কথা আদানির।

কিন্তু আদানি পাওয়ার তা করেনি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ও ২২ অক্টোবর বিপিডিবির পক্ষ থেকে আদানির কাছে দুই দফায় চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সুবিধার বিপরীতে বাংলাদেশে সরবরাহ করা বিদ্যুতের দামে সমন্বয়ের আহ্বান জানানো হয়। এসব চুক্তি এবং চিঠি সবার জন্য উন্মুক্ত না হলেও রয়টার্স দেখেছে বলে জানিয়েছে।

গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিপিডিবির দু’জন কর্মকর্তা বলেছেন, দুই দফায় চিঠি দেওয়া হলেও তারা আদানি পাওয়ারের কোনও সাড়া পাননি।

কর্মকর্তারা বলেছেন, ভারত সরকারের কাছ থেকে যে করছাড় পেয়েছে আদানি পাওয়ার, সে অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ধরা হলে বাংলাদেশের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে প্রায় শূন্য দশমিক ৩৫ সেন্ট সাশ্রয় হবে বলে বিপিডিবির ধারণা।

গড্ডা প্ল্যান্ট থেকে কেনা বিদ্যুতের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি সারসংক্ষেপ দেখেছে রয়টার্স। সারসংক্ষেপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত গড্ডা প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে ৮ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। কর ছাড়ের বিষয়টি সমন্বয় করা হলে এই বিদ্যুতে বাংলাদেশের প্রায় ২৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হতো।

জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রয়টার্সকে বলেছেন, সাশ্রয়ের বিষয়টিই আদানি পাওয়ারের সঙ্গে ভবিষ্যতের আলোচনার মূল বিষয় হবে।

• তড়িঘড়ি করে চুক্তি

গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ২০১০ সালের একটি জ্বালানি আইন বাতিল করেছে। ওই আইনে প্রতিযোগিতামূলক নিলাম প্রক্রিয়া ছাড়াই কিছু জ্বালানি চুক্তির অনুমতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের পরিচালক টিম বাকলি বলেন, নিলামের মাধ্যমে ‘‘সম্ভাব্য সেরা দর’’ নিশ্চিত হয়। আদানির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে দরপত্র প্রক্রিয়া না থাকাটা অস্বাভাবিক।

শেখ হাসিনার স্বাক্ষরিত বড় জ্বালানি চুক্তিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য গত সেপ্টেম্বরে বিশেষজ্ঞ প্যানেল নিয়োগ করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। এছাড়া বাংলাদেশের উচ্চ আদালত আলাদাভাবে আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার বিষয়ে গঠিত আরেকটি কমিশন গত ১ ডিসেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া এক শ্বেতপত্রে বলেছে, আদানির বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযোগ গঠনের অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশেরও বিদ্যুৎ চুক্তিটি ‘‘পর্যালোচনা’’ করা উচিত। চুক্তিটি করার সময় তাড়াহুড়ো করা হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করেছে কমিশন।

গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এই বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। তবে তার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির বিষয়ে অবগত নন। কিন্তু এই চুক্তিতে কোনও ধরনের দুর্নীতি হয়নি বলে তিনি নিশ্চিত।

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি কেবল অনুমান করতে পারি, ভারত সরকার এই চুক্তির জন্য লবিং করেছিল। তাই চুক্তিটি করা হয়েছে।’’ এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কার্যালয় ও অন্যান্য ভারতীয় কর্মকর্তারা সাড়া দেননি।

• আদানির সঙ্গে টানাপড়েন

বকেয়া নিয়ে বিরোধের কারণে গত ৩১ অক্টোবর ঝাড়খণ্ডের এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে হঠাৎ করেই বাংলাদেশে সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়।

রয়টার্স কোম্পানিটির গত ১ জুলাইয়ের একটি চিঠি দেখতে পেয়েছে। যেখানে বিদ্যুতের মূল্যছাড় অব্যাহত রাখার বিষয়ে বিপিডিবির করা একটি অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে আদানি পাওয়ার। মে মাস পর্যন্ত আদানি পাওয়ার ওই মূল্যছাড় সুবিধা দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়। কোম্পানিটি বলেছে, বকেয়া পরিশোধ না করা পর্যন্ত তারা নতুন করে আর কোনও মূল্যছাড় দেবে না।

আদানি পাওয়ার বাংলাদেশের কাছে ৯০০ মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে বলে দাবি করেছে। আর বিপিডিবি বলছে, আদানির বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে ডলার সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। যে কারণে অর্থপ্রদানের জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যাচ্ছে না বলে বিপিডিবির কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন।

বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেছেন, ‘‘আদানি পাওয়ার বিদ্যুতের সরবরাহ অর্ধেক করায় বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে। কারণ গত অক্টোবরে আদানি পাওয়ারকে ৯৭ মিলিয়ন ডলার পরিমোধ করা হয়েছে; যা চলতি বছরে সর্বোচ্চ মাসিক পাওনা পরিশোধ।’’

২০১৭ সালের চুক্তিতে গড়ে দুটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। মূলত বিদ্যুতের শুল্ক নির্ধারণ করা নিয়েই এখন উভয়পক্ষের মাঝে বিরোধ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেনার সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, গড্ডা থেকে বাংলাদেশে সরবরাহ করা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের যে মূল্য ধরা হয়, তা ভারত থেকে ঢাকায় বিক্রি হওয়া সব বিদ্যুতের গড়ের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি।

বিপিডিবির তিনটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, গত বছর চুক্তির একটি সূচকে সংশোধনী আনার পর এখন দাম কমানোর জন্য অন্যান্য মানদণ্ড ব্যবহারে আদানি পাওয়ারকে চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ। এসব মানদণ্ড অনুসরণ করা হলে বিদ্যুতের দাম কমে যাবে। ওই তিন সূত্রের একজন বলেছেন, আদানি পাওয়ার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। শিগগিরই উভয়পক্ষ বৈঠকে বসবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

চুক্তি নিয়ে সিঙ্গাপুরে সালিশি করার শর্ত থাকলেও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, আদালতের নির্দেশে শুরু হওয়া তদন্তের ফলাফলের ওপর বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করবে। তিনি বলেন, তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় যে, চুক্তিতে ঘুষ বা অনিয়ম হয়েছে, তাহলে বাতিলের ক্ষেত্রে আমাদের আদালতের আদেশ অনুসরণ করতে হবে।

সূত্র: রয়টার্স।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন