
লাখ লাখ পড়ে আছে মৌমাছির নিথর দেহ, দিশেহারা মৌ চাষী আরজু আলম
মাহিদুল ইসলাম রিপন দিনাজপুর প্রতিনিধি :
কাঠের তৈরী আয়তাকার বাক্সের অভ্যন্তরে মৌমাছির চাক। বাক্সটির উপরের অংশ প্লাস্টিকের ছাউনিতে মোড়ানো। আরজু আলম (৩৫) প্রতিদিন সকালে বাক্স খুলে দেখেন প্রিয় মৌমাছিগুলো সুস্থ আছে কিনা কিংবা চাকে থাকা রানী মৌমাছির অবস্থা কি। কেমন আছে কর্মী মৌমাছিরা? চাকে মধুইবা জমেছে কতখানি? তাঁকে দেখে ভনভন শব্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে মাছিরাও জানান দেয় সুস্থতার কথা। কিন্তু গত দেড় সপ্তাহে সেই ভনভন শব্দ নেই। বাক্সের আশেপাশে পড়ে আছে লাখ লাখ মৌমাছির নিথর দেহ। একদিকে মৌমাছির মারা যাবার শোক অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে মৌ-চাষী আরজু আলম এখন দিশেহারা।
মৌ-চাষী আরজু আলমের বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলার লামকান গ্রামে। ২০১০ সালে ১৫টি বাক্স নিয়ে শুরু করেন মৌমাছির খামার। এরপর কেটে গেছে দেড় দশক। তাঁর খামারে এখন ২০০টি বাক্স। প্রতি মৌসুমে অক্টোবরের শেষ সময় থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ মৌ-বাক্স নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খামার স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করেন আরজু। এবার লিচুর মৌসুমে গত ২০ মার্চ দিনাজপুরের বিরল উপজেলার জোড়কালি এলাকায় খামার বসিয়েছেন। মধু বিক্রির টাকায় চলে আরজুর পাঁচজনের সংসার। কিন্তু মৌমাছিগুলো মারা যাওয়ায় সেই আয়ের পথ বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। আরজুর দাবি খামার স্থাপনের তিনদিনের মাথায় লিচু গাছে কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন বাগান মালিক। সেই কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় মারা পড়েছে খামারের সব মাছি।
আরজুর মত এবার ওই এলাকায় তিনজন খামারী দেড় হাজার মৌ-বাক্স স্থাপন করেছেন। প্রায় সবার খামারের মৌমাছি মারা পড়েছে। মৌখামারীরা জানান, মৌমাছি ফুলে পরাগায়ন ঘটানোর ফলে লিচুর ফলন বৃদ্ধি হয়। মুকুল আসার আগে বাগান মালিকরা একবার কীটনাশক ছিটিয়েছেন। সাধারণত গুটি আসার পরে পুনরায় কীটনাশক ছিটানোর কথা। কিন্তু এবার মুকুল থাকা অবস্থাতেই কীটনাশক ছিটানো হয়েছে। যদিও কয়েকজন চাষী জানান, উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে পোকা মাকড় দমনের জন্য বিষ প্রয়োগ করেছেন তারা।
লিচুর বাগান ও মৌখামার ঘুরে দেখা যায়, খামারে প্রতিটি বাক্সের চারপাশে লাখ লাখ মৌমাছি মরে আছে। কয়েকজন কর্মচারী বাক্স থেকে কাঠের ফ্রেমে থাকা চাকগুলো বের করে স্তুপ করে রাখছেন। বাগানের একপাশে তাবু টানানো হয়েছে। মৌয়ালী আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমরা শেষ হয়ে গেলাম। মধু না পেতাম তাতে সমস্যা ছিলোনা। কিন্তু এতগুলো বাক্সে পুনরায় মাছি যোগাড় করা কঠিন হয়ে যাবে। মৌসুম শেষে এই মাছিগুলোকে চিনির সিরা খাওয়ানোসহ নানা পরিচর্যা করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। ওই সময়টাতে অন্য কোন কাজ করার সুযোগ থাকে না আমাদের। একটি বাক্সে সাধারণত ৮টি ফ্রেম(ঢাল) থাকে। মাছিসহ কিনতে গেলে একটি বাক্সের খরচ পড়বে বর্তমান বাজারে সাত থেকে আট হাজার টাকা।’
লিচু চাষের জন্য প্রসিদ্ধ দিনাজপুর জেলা। কমবেশি প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বোম্বাই-মাদ্রাজী-বেদানা-চায়না থ্রী-মোজাফফরী-কাঁঠালী জাতের লিচুর আবাদ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী জেলায় ৫ হাজার ৫২০হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান আছে ৫ হাজার ৪৫০টি। এরমধ্যে বোম্বাই লিচু ৩ হাজার ১৭০হেক্টর, মাদ্রাজি ১ হাজার ১৭০ হেক্টর, চায়না থ্রি ৮০৫ হেক্টর, বেদানা ৩১৮ হেক্টর, কাঁঠালি ৫৬ হেক্টর এবং মোজাফফরি লিচুর বাগান রয়েছে ১ হেক্টর জমিতে।
গত ১৫ বছর থেকে এ অঞ্চলে লিচুর মধু সংগ্রহে আসছেন মৌয়ালীরা। মৌসুমে চাষীরাই তাদের আসতে উদ্বুদ্ধ করেন। মৌয়ালি আরজু আলম বলেন, ‘এবারে লিচুতে মুকুল বেশি এসেছে। লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহে আমরা সময় পাই সর্বোচ্চ ১৫-২০দিন। এই সময়ে দেড় হাজার বাক্স থেকে কমপক্ষে ২০-২২টন মধু সংগ্রহ হবার কথা। প্রতি টন সর্বনিম্ন তিন লাখ টাকা বাজার পেলেও প্রায় ৬০লাখ টাকার মধু বিক্রি করতে পারতাম। সেক্ষেত্রে আমরা সংগ্রহ করতে পারছি মাত্র দুই থেকে আড়াই টন। কর্মচারীসহ দশজন আসছি। এবারে ঈদও খামারেই কেটেছে আমাদের। পাঁচ এপ্রিলের পরে কীটনাশক প্রয়োগ করলে সমস্যায় পড়তে হতো না। ততদিনে আমরা সংগ্রহ শেষ করতে পারতাম। কিন্তু এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
এ বিষয়ে বিরল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা হাসান ইমাম বলেন, ‘লিচুর ফলন বৃদ্ধিতে মৌমাছির ভূমিকা অনেক বেশি। এ বিষয়ে চাষী ও মৌয়ালীদের মধ্যে বিগত দিনগুলোতে সমন্বয় ছিলো। ২৩ মার্চ মৌয়ালীরা গাছে কীটনাশক প্রয়োগের কথা জানালে সরেজমিন গিয়ে চাষীদের কীটনাশক প্রয়োগ করতে নিষেধ করি। কারণ তখনও গুটি বের হয়নি। সাধারণত গুটি মোটরদানার মত আকৃতিতে আসলে এই স্প্রেটা করার কথা। তবে উভয়পক্ষের মধ্যে সমন্বয়নহীনতায় এই ঘটনাটি ঘটেছে। বিষয়টি দু:খজনক।
মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন
আপনি ও পছন্দ করতে পারেন
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
আর্কাইভ!
অনুগ্রহ করে একটি তারিখ নির্বাচন করুন!
দাখিল করুন