ডার্ক মোড
Saturday, 21 December 2024
ePaper   
Logo
বানিয়াচংয়ের কৃতিসন্তান ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ'র মৃত্যুবার্ষিকী

বানিয়াচংয়ের কৃতিসন্তান ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ'র মৃত্যুবার্ষিকী

বানিয়াচং (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি

বানিয়াচংয়ের কৃতিসন্তান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুবার্ষিকী (২০ ডিসেম্বর)। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গের কামালখানী হাসান মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর বাবার নাম মরহুম সিদ্দিক হাসান এবং মায়ের নাম মরহুমা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। সিদ্দিক হাসান ছিলেন হবিগঞ্জের সাবরেজিস্ট্রার। ফজলে হাসান আবেদের বাবা ও চাচারা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তাঁর দাদার নাম খানবাহাদুর মরহুম রফিকুল ইসলাম। তাঁর নানা খানবাহাদুর সৈয়দ মোয়াজ্জেম উদ্দীন হোসেন ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কৃষিমন্ত্রী এবং পরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

ফজলে হাসান আবেদের নানাবাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে। ফজলে হাসান আবেদের বাবা সিদ্দিক হাসানের মামার নাম সৈয়দ শামসুল হুদা। যিনি নওয়াব জাস্টিস স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি কলকাতার প্রথিতযশা উকিল ছিলেন। পরে তিনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নরের নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। তাঁরা এখনকার মন্ত্রিসভার মতো বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সরকার চালাতেন। সৈয়দ শামসুল হুদা ছিলেন এই কমিটির প্রথম ভারতীয় সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। ফজলে হাসান আবেদ তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে।

এরপর কুমিল্লা জেলা স্কুলে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৫২ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। পাস করার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পড়ার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া বাদ দিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। তখন ফজলে হাসান আবেদের ছোট চাচা সায়ীদুল হাসান ছিলেন লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাণিজ্য সচিব। তিনি ভাতিজা আবেদকে স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হতে বললেন। ১৯৫৪ সালে স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। দুই বছর লেখাপড়া করার পরে নেভাল আর্কিটেকচার পড়া বাদ দিয়ে অ্যাকাউন্টিংয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৫৬ সালে ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে এবং ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। ১৯৬২ সালে ‘কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং’-এর ওপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন। ফজলে হাসান আবেদ ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭০ সালে শেল অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স হিসেবে চট্টগ্রামে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরা এই তিনটি দ্বীপের লাখ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যুবরণ করেছিল। ফজলে হাসান আবেদ এবং তাঁর বন্ধু ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, সহকর্মী কায়সার জামান, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আকবর কবীর এবং নটর ডেম কলেজের শিক্ষক ফাদার টিম মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন ত্রাণ বিতরণ করতে মনপুরাতে যাবেন।

‘হেলপ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে তার মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়েছিলেন। সর্বস্ব এবং স্বজন হারানো মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি তারা তৈরি করে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্যার ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানির উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইসলামাবাদ ও কাবুল হয়ে লন্ডনে চলে যান। ১৯৭১ সালের মে মাসে লন্ডনে গিয়ে সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সম্পৃক্ত হলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তুললেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটো সংগঠন। অ্যাকশন বাংলাদেশ-এর কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমর্থন আদায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত তৈরি এবং পাকিস্তানি বাহিনির বর্বরোচিত কার্যকলাপ বন্ধের জন্য ইউরোপীয় দেশসমূহের সরকারকে সক্রিয় করে তোলা। ‘হেলপ বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিল অর্থসংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা।

তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করা, প্রচারণাপত্র বিলি করা, টাইমস অব লন্ডনে লেখা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা, রেডিও ও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া, ইউরোপীয় দেশসমূহের পার্লামেন্ট সদস্যদের আলোচনার মাধ্যমে স্বদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিবিধ কর্মতৎপরতা পরিচালনা করা। এ ছাড়া পথনাটকাভিনয় থেকে শুরু করে তহবিল সংগ্রহসহ নানা ধরনের কাজে তিনিসহ তাঁর বন্ধুরা যুক্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ফজলে হাসান আবেদ লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ফেরার সময় তাঁর লন্ডনের ছোট ফ্ল্যাটটি ৬ হাজার ৮শ পাউন্ড দামে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালেই তিনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি সংক্ষেপে ‘ব্র্যাক’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই অঞ্চলে কাজ শুরু করেন।

শুরুতে ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা দিয়ে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তের কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদের সুযোগ্য নেতৃত্বই অজস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকের অনন্যসাধারণ এই অর্জনকে সম্ভব করে তুলেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্র্যাকের মডেল অনুসরণ করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে এবং ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দারিদ্র বিমোচনে বিশেষ ভূমিকার জন্য ব্রিটেন কর্তৃক ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে "নাইটহুডে" ভূষিত হন। সেই থেকে তিনি বিশ্বব্যাপী স্যার ফজলে হাসান আবেদ হিসেবে স্বীকৃত। ফজলে হাসান আবেদ নাইটহুড উপাধি ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদকসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন।

ব্র্যাক এনজিও ছাড়াও ব্র্যাক ব্যাংক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, আড়ংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ফজলে হাসান আবেদ'র স্মৃতি বহন করে সগৌরবে টিকে আছে। নিজ এলাকা বানিয়াচঙ্গে আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশন নামে আড়ং পণ্যের উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। যা এলাকার দরিদ্র নারীসমাজের কর্মসংস্থান ও জীবনমান উন্নয়নে অবদান রাখছে। এছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবী সায়ীদুল হাসানের নামে বানিয়াচঙ্গে একটি গণপাঠাগার নির্মাণ করা হয়। এটি নির্মাণেও ফজলে হাসান আবেদের অবদান। বানিয়াচঙ্গে হবিগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি নাজমুল হাসান জাহেদ'র নামে নাজমুল হাসান জাহেদ একাডেমি নামক আন্তর্জাতিক মানের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এটিও ফজলে হাসান আবেদের অবদানে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন