
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে
জাহিদুল ইসলাম
দিন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছে। কাজকে সহজ করা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও সৃজনশীলতাকে আরও উন্নত করায় এআই বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ব্যক্তিগত ব্যবহারে বা বিভিন্ন পেশার ক্ষেত্রে এআইয়ের ক্ষমতা সাধারণ কাজ থেকে শুরু করে জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন দিক খুলে দিচ্ছে। বিশ্বের যত সৃষ্টি আছে তার মধ্যে মানুষকে আলাদা করা যায় যে বৈশিষ্ট্যটির মাধ্যমে তাহলো তার বুদ্ধিমত্তা। দীর্ঘদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করতে করতে বিজ্ঞানীরা এমন ধারনায় এসেছেন যে মানুষের মগজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্রের চেয়ে অনেক উন্নত। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যত বেশি মানুষের মগজের মতো করার চেষ্টা করা হবে ততই তার উন্নতি হবে। একজন মানুষের মগজের
ট্রিলিয়ন আন্তসংযোগ আছে। পৃথিবীজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্মাতারা প্রাণপণে চেষ্টা করছেন যত বড় করে সম্ভব একটা অধিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম তৈরি করতে। আর এই কাজটা যে হারে এগোচ্ছে এতে মনে হয় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম ১০০ ট্রিলিয়ন কানেকশন বা আন্তঃসংযোগ তৈরি করে ফেলতে পারবে। আমাদের মস্তিষ্ক ভাবনার এক অনাবিল জগৎ। বর্তমানে সেই মস্তিষ্কই করছে নতুন মস্তিষ্কের ভাবনা। প্রযুক্তি দুনিয়ার বর্তমান সময়ে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম উপায়ে যন্ত্রকে বুদ্ধিমান বানানোর প্রযুক্তিই হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি (এআই)। ইয়ান লেকুন, জেফ্রি হিন্টন ও ইউসুয়া বেনজিও-এই তিনজনকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই জগতের দিকপাল বলা হয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আজকের জায়গায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। তিনজনই ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে কম্পিউটারবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য টুরিং পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়াও পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারও গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করা দুই শীর্ষ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জন হপফিল্ড ও জেফরি হিন্টনের হাতে। আমরা যে পদ্ধতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করেছি সেটি অনেকটাই রূপকথার আলাদীনের চেরাগের ভিতরে থাকা দৈত্যের মতোই। রূপকথার গল্পে আলাদীন যখনি চেরাগে হাত দিয়ে ঘষা দিত তখন দৈত্য বেরিয়ে আসতো আর আলাদীনে যা বলত দৈত্যে তাই করত। এখন বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার সক্ষমতার দ্বারা সেটা করে দেখাচ্ছে। বর্তমান সময়ে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৈত্য যতই শক্তিশালী হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে এটি ততই অতিবুদ্ধির অধিকারী হয়ে উঠবে। সম্প্রতি সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে ভবিষ্যতে এটি হয়ত ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যাবে। তখন সেটি মানবসভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকিতে পরিণত হবে। অতিবুদ্ধির অধিকারী হয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমগ্র মানবজাতির জন্য শত্রু হয়ে উঠতে পারে। যে শত্রু আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা মানবসভ্যতার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এদিকে আমাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনকে নাটকীয়ভাবে ভালো বা মন্দ উভয় অর্থেই পাল্টে দেয়ার দারুণ ক্ষমতা রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে মিথ্যা বলা শিখে গেছে এআই। তাই চিন্তা বাড়ছে বিজ্ঞানীদের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন শুধু তথ্য বিশ্লেষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না বরং এর পাশাপাশি প্রতারণার কৌশলও রপ্ত করে ফেলছে। ঠিক এমনটাই প্রকাশ পেয়েছে সাম্প্রতিক এক গবেষণা। এমআইটির বিজ্ঞানীদের পরিচালিত এই গবেষণায় উঠে এসেছে এক উদ্বেগজনক তথ্য। যেখানে দেখা গিয়েছে যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিচ্ছে, কৌশলগত প্রতারণায় লিপ্ত হচ্ছে এবং এমনকি নিজেকে মানুষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টাও করেছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে কূটনৈতিক বোর্ড খেলায় এআই মিথ্যা বন্ধুত্ব গড়ে তুলে পরে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আবার কিছু এআই ব্যবস্থা প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়দের বিভ্রান্ত করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। অন্যদিকে কিছু এআই ক্ষেত্রে ছলনার আশ্রয় নিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাজিতও করেছিল। সত্যিকার অর্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই প্রবণতা ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যখন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের বাস্তব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে এআই-এর প্রতারণা শুধু খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এদিকে গবেষকদের মতে অর্থনৈতিক আলোচনার সময়ও এটি মিথ্যা বলছে। আবার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য মানব পর্যালোচকদের বিভ্রান্ত করছে এবং এমনকি সুরক্ষা পরীক্ষাগুলোকে ফাঁকি দিয়ে বিপজ্জনক আচরণ গোপন করছে। এই নতুন বাস্তবতা বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই প্রতারণার ক্ষমতা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবে তা সমাজের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। অপরদিকে গত কয়েক বছরে দেশে ডিজিটাল লেনদেন জ্যামিতিকহারে বেড়েছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে জালিয়াতিও। যার ভিত্তি হচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষের উচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা রোবট বা যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ভয়ঙ্কর নেতিবাচক দিক হলো ডিপ ফেক। কোনো একজন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার চেহারা ও কণ্ঠস্বর ব্যবহার করার প্রযুক্তি হলো ডিপ ফেক। নেতিবাচক ব্যবহারের কারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে তথা প্রযুক্তি খাতে এটি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা উপলব্ধি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির যে জায়গায় আমরা আজ এসে দাঁড়িয়েছি খুব সম্ভবত তা এখনই মানুষের মগজের চেয়ে ভালো। এখন শুধু এটাকে আরেকটু বেশি মাত্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া বাকি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে তাতে করে ভবিষ্যতে ঘটে যেতে পারে নানান অঘটন। এখন থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি হয়ে উঠবে ধ্বংসাত্মক, বেপরোয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীন। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে পর্যায়ে চলে যাচ্ছে তাতে করে তা অচিরেই মানুষের চেয়ে বেশি স্মার্ট হয়ে যাবে এবং নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। সম্প্রতি নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অকল্পনীয় মাত্রায় তথ্য আত্মস্থ ও বিশ্লেষণ করতে গবেষণাকর্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সাহায্য করছে। এ কারণেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন ছবি চিনতে পারে, ভাষা বুঝতে পারে এবং নিজে নিজে গাড়িও চালাতে পারে। তার অবস্থাটা এখন দাঁড়িয়েছে অনেকটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের (কৃত্রিমভাবে তৈরি দুর্দান্ত শক্তি, গতি এবং কুৎসিত মুখের অতিমানব) গল্পের দানবের ঘটনার মতো। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে কাজ করেছিলেন তখন তারই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা অতিমানবীয় ক্ষমতায় দানব দেখে তিনি ভীত হয়ে গিয়েছিলেন। এতে তিনি অদ্ভুত এক মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ বিষয়টা যদি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে মানবসভ্যতা, সমাজ এবং বিজ্ঞানের ভালোর জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে সারা জীবন কাজ করার পরে শেষে যদি দেখা যে কাজের ফলাফল মানব সভ্যতার জন্য ধ্বংস ডেকে এনেছে তবে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। কীভাবে প্রযুক্তির এ অপপ্রয়োগের লাগাম টানা যায় তা নিয়ে আমাদের এখন থেকেই ভাবতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই প্রযুক্তি যে বিপদ তৈরি করেছে প্রযুক্তির মাধ্যমেই তার সমাধানের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এর পাশাপাশি আমাদের সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ শক্তিকে ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করতে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।