হাড়িধোয়ার নদীর পানি ‘কুচকুচে কালো’
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
হাড়িধোয়া নদীটি দূষণে ধুকছে। পানির রং কুচকুচে কালো। পানি হাতে নিলে দুর্গন্ধ নাকে আসে। এই পানি ব্যবহারে ছড়াচ্ছে চর্মরোগ। পুরো গোপালদীবাজার পৌর এলাকায় চুলকানিসহ নানা চর্মরোগ ছড়িয়েছে হাড়িধোয়া নদী। পানির অপর নাম জীবন হলেও হাড়িধোয়ার পানি এখন মরনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য দায়ী শিল্পকারখানা। কিছু শিল্প উদ্যোক্তা। যারা নিজেদের প্রয়োজনে হাড়িধোয়া নদীকে ব্যবহার করে নদীটিকে ঠেলে দিচ্ছেন মৃত্যুর দিকে।
নরসিংদী জেলার মাধবদী হয়ে হাড়িধোয়া নদীটি আড়াইহাজার উপজেলায় প্রবেশ করেছে। নরসিংদী সদর উপজেলায় ছোট বড় প্রচুর নদ-নদী রয়েছে। এদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো মেঘনা, হাড়িধোয়া ইত্যাদি। নরসিংদী সদর উপজেলার চৌদ্দটি ইউনিয়নের মধ্যে চারটি ইউনিয়নই চরাঞ্চল। এ ইউনিয়ন সমূহ মেঘনা নদী দ্বারা বেষ্টিত। হাড়িধোয়া নদী নরসিংদী সদর উপজেলা এবং শিবপুর উপজেলাকে বিভক্ত করেছে।
নরসিংদী-আড়াইহাজার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সে নদীর পানি এখন বিষাক্ত। দূষণে দূষণে নদীর পানি এখন ব্যবহার অনুপযোগী। নদী তীরের মানুষের দূর্বিসহ অবস্থায় পড়তে হয়েছে। অন্যদিকে দখলের কবলে পড়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে হাড়িধোয়া। শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত নদীটি এখন এলাকাবাসীর জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এখানকার কৃষি, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য।
নরসিংদী জেলা শহরের বৌয়াকুড়, হাজীপুর, বীরপুর, পুরানপাড়া, বাদুয়ারচর, পুটিয়া, শেরপুর, ভরতেরকান্দি, ঘোড়াদিয়া, সোনাতলা, কারারচর, চরনগরদী, নোয়াকান্দা, গজারিয়া, শালুরদিয়া গ্রামসহ নদী পাড়ের হাজার হাজার পরিবার চরম দূর্বিসহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এক সময় অনেক জেলে পরিবার এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত।
হাড়িধোয়া নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নরসিংদী জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৬১ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা "পাউবো" কর্তৃক মরা হাড়িধোয়া নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং ৬১।
হাঁড়িধোয়া বয়ে গেছে নরসিংদী জেলা শহর ঘেঁষে। নদীটি ছিল খরস্রোতা। নরসিংদীবাসীর জন্য আশীর্বাদ ছিল এই নদী। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম ও শিবপুর উপজেলার পশ্চিম-উত্তর শীতলক্ষা নদীর প্রান্ত থেকে প্রায় ৬০-৭০ কিলোমিটার নদীটি আঁকাবাঁকা হয়ে নরসিংদী জেলা শহরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে এসে মেঘনার নদীর মোহনায় মিলিত হয়েছে। এই নদী পথে ব্যবসা বাণিজ্যসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা ছিল। নদী পাড়ের মানুষের কৃষি জমি ছিল ফসলে ভরা, নদীর পানিতে ছিল প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছের ছড়াছড়ি।
হাজীপুর গ্রামের জেলে নেপাল চন্দ্র দাস বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকেই হাড়িধোয়া নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু কয়েকটি কলকারখানার বর্জ্যে এই নদীর পানির এমন দশাই হয়েছে যে, মাছতো দূরের কথা সাপ, ব্যাঙ, কীটপতঙ্গসহ সকল জীব-বৈচিত্রই আজ ধ্বংসপ্রায়।
নরসিংদী শহরতলীর ঘোড়াদিয়া, শিবপুরের কারারচর এলাকা ও বিসিক শিল্পনগরীর বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানার সরাসরি নিক্ষিপ্ত বর্জ্যে হাড়িধোয়ার পানি কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। হাড়িধোয়ার বিষাক্ত পানি মিলিত হয়ে দূষিত হচ্ছে মেঘনা নদীর পানিও। পানির দুগর্ন্ধে নদীর তীরে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
কারারচর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ মাহাবুবুর রহমান ভূইয়া জানান, নদীর দূষিত পানির দুর্গন্ধে বাড়ীতে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দিনরাত এই দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি অবস্থা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনিয়র কেমিষ্ট মোঃ আতাউর রহমান বলেন, ‘নরসিংদীতে যে কয়টি কারখানার মালিক তারা অধিকাংশই কোন না কোন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত।’
নরসিংদী ও ঢাকা অফিস যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে সম্প্রতি নরসিংদীর নদী বাংলা গ্রুপের ৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৮০ লাখ টাকাসহ পলাশের স্যামরি ডাইং কেমিক্যাল, প্রাণ কোম্পানি, হামিদ ফেব্রিক্স, বৈশাখী স্পিনিং মিলসসহ বেশ কয়েকটি কারখানা থেকে প্রায় কোটি টাকার জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
নরসিংদী জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে, এসব চালু হলে নদীর পরিবেশ দূষণ সমস্যা আর থাকবে না। হাড়িধোয়া নদী রক্ষাসহ পরিবেশ দূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কর্তৃপক্ষ।
নদীকে দূষণের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে বহু নীতি ও নথি আছে । বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ এর ১৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, সরকার নির্বাহী কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে জলাধার বা পানিধারক স্তরের সুরক্ষার জন্য যথাযথ অনুসন্ধান, পরীক্ষা নিরীক্ষা বা জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যেকোনো এলাকা বা উহার অংশবিশেষ।