ডার্ক মোড
Monday, 18 August 2025
ePaper   
Logo
সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিবা কোথায়

সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিবা কোথায়


ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক

সকালের আলো ফোটার আগেই রাষ্ট্র নামক রোগীর ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় কুঁকড়ে পড়া শরীরটা একরকম উঠে দাঁড়ায়—কোমরে হাত, চোখে ঝাপসা, কানে তালা। ব্যথার উপসর্গ এতটাই ব্যাপক যে কেউ জিজ্ঞেস করলে সোজাসাপ্টা উত্তর—"সর্বাঙ্গে!" মাথা ধরে, হৃদস্পন্দন অনিয়মিত, নিঃশ্বাসে কষ্ট, হাঁটার শক্তিও নেই। অথচ আশপাশে হৈচৈ, চিৎকার, স্লোগান, সংস্কারের ঢাক ঢোল—তবু কেউ রোগীর হালচাল জানতে চায় না।

এই রাষ্ট্র যেন এক জীর্ণ মানবদেহ। যার মাথা রাজনীতি, হৃদপিণ্ড অর্থনীতি, ফুসফুস গণমাধ্যম, পা দুটো বিচারব্যবস্থা এবং মেরুদণ্ড গণতন্ত্র। এখন মাথা ধরেছে হিংসার, হৃদয়ে দুর্নীতির ক্লট, ফুসফুসে মতপ্রকাশের অ্যাজমা, পায়ে ন্যায়ের জড়তা—আর মেরুদণ্ড? সেটি তো ‘ডিসলোকেটেড’। ডাক্তাররা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও, কেউ হাত দিতে রাজি নন—কারণ, সংক্রমণের ভয় তাদেরও।

সবচেয়ে দুর্ভাগ্য—এই রাষ্ট্ররোগের চিকিৎসকরা দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত। প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকে "সংস্কার", "উন্নয়ন ", "আত্মনির্ভরতা"কিন্তু ওষুধে নেই নিরাময়ের নিশ্চয়তা। কেউ ঘুমপাড়ানি সংস্কারের ইনজেকশন দেয়, কেউ ‘স্বপ্নের ট্যাবলেট’ চালান করে। আর মিডিয়ায়, সেমিনারে, আলোচনায় রোগ নির্ণয়ের বদলে হয় বক্তৃতার প্রতিযোগিতা। রাষ্ট্র যখন ব্যথায় কাতর, তখন নীতিনির্ধারকরা বলেন—"রোগী সুস্থ, কিছু কুচক্রী মহল ব্যথা ছড়াচ্ছে!"

অন্যদিকে, বিদেশি চিকিৎসকদল এসে গম্ভীর মুখে বলে—"রোগীর গণতন্ত্র দুর্বল, মানবাধিকার হুমকির মুখে, নির্বাচনী শিরদাঁড়া বিকল!" তারা চিকিৎসা নয়, রিপোর্ট তৈরি করে; রোগীর সেবা নয়, কনসালটেন্সি চুক্তিতে ব্যস্ত। কেউ স্যালাইন দিতে চায় মানবাধিকারের নামে, কেউ গণতন্ত্রের পেইনকিলার, কেউ আবার উন্নয়নের মাল্টিভিটামিন।

এনজিও নামক বৈদেশিক ফার্মেসিগুলোও বসে নেই। তারা ‘সহযোগিতা’ নামক প্যাকেটে বিতরণ করছে নানা ইনজেকশন: নাগরিক প্রশিক্ষণ, মূল্যবোধ উন্নয়ন, ভোটার সচেতনতা, গার্ডিয়ান পার্টিসিপেশন! কিন্তু এই ইনজেকশনগুলো রোগীকে সুস্থ করে না—বরং তার আত্মমর্যাদায় চেপে বসে। দেশের ‘স্বেচ্ছাসেবক’ টেকনিশিয়ানরা আসলে বিদেশি প্রেসক্রিপশন বিলি করে বলে—“দেশি উপায়ে হবে না, আগে ‘ডেমোক্রেসি ফর অল’ কোর্স করে আসুন!”

রাষ্ট্রের রোগটি বহুমাত্রিক। একদিকে দুর্নীতি নামক ভাইরাসে শরীরটা প্রায় নিঃশেষ, অন্যদিকে ক্ষমতা-কেন্দ্রিক ইনজেকশনে মাথা ভারী। বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক জলবায়ুতে রক্তচাপে ওঠানামা করে, গণমাধ্যমের ফুসফুসে বাঁধা টেপ—জোরে শ্বাস নিলে মামলার ভয়। আর অর্থনীতির হৃদপিণ্ডে এখন বাজেট নয়, বাণী বাজে। এই যখন অবস্থা, তখন প্রশ্ন—চিকিৎসা হবে কীভাবে? বিদেশি প্রেসক্রিপশনে, না দেশি বাস্তবতায়?

রাষ্ট্র এখন ক্রনিক রোগে আক্রান্ত এক গর্বিত রোগী। সে জানে, নিজের ব্যথা কেউ বুঝবে না। তাই নাগরিকেরা নিজেরাই হয়ে উঠছে নার্স, থেরাপিস্ট, কখনো কখনো সার্জন। কেউ আর বাহারি মোড়কে ওষুধ নিতে চায় না—তারা প্রশ্ন করে, "এই ডোজে কি আসলেই উপকার হবে, নাকি এটাও রাজনৈতিক প্যারাসিটামল?"

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—রাষ্ট্র নামক এই দেহের সর্বাঙ্গে এখন ব্যথা। শুধু ব্যথানাশক দিয়ে আর কাজ হবে না। প্রয়োজন সঠিক রোগ নির্ণয়, এবং সেই অনুযায়ী দেশি চিকিৎসা ব্যবস্থা। যে চিকিৎসকরা রাজনীতি নয়, পেশাদারিত্বে বিশ্বাস করেন; উন্নয়ন নয়, সুবিচারে আস্থা রাখেন; বিদেশি ফার্মাসির পরামর্শ নয়, জনগণের বাস্তবতা বোঝেন—তাদের হাতেই রাষ্ট্র সুস্থ হতে পারে।
না হলে একদিন রাস্তায় পড়ে যাওয়া এই রাষ্ট্র কাতরস্বরে বলবে—
“এই যে রাষ্ট্র... সর্বাঙ্গে ব্যথা! ওষুধ দিবা কোথায়?”


রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তক
ইমেইল - fokoruddincse@gmail.com

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন