
যশোরে মুক্তেশ্বরী নদী গায়েব, ভরাট করে চলছে প্লট বিক্রি
জেমস আব্দুর রহিম রানা, যশোর
যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নে মুক্তেশ্বরী নদীর প্রায় ১০ বিঘা জায়গা ভরাট করে প্লট বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। নদীর ওই অংশ সম্পূর্ণ দখল হয়ে যাওয়ায় বিল হরিণায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, হুমকির মুখে পড়েছে হাজারো বিঘা জমির আমন চাষ।
সরেজমিন দেখা গেছে, চাঁচড়া দক্ষিণপাড়া ও ভাতুড়িয়া পূর্বপাড়ার মাঝামাঝি নদীটি মাটি ফেলে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে। উত্তর প্রান্তে বাঁধ দিয়ে প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে, আর সেখানে টাঙানো হয়েছে প্লট বিক্রির সাইনবোর্ড। স্থানীয়রা বলছেন, আগে এ পথে বর্ষার পানি ও যশোর শহরের পানি দক্ষিণমুখী হয়ে বিল হরিণায় পড়ত। এখন নদীর পথ বন্ধ থাকায় পানি শুধুই জিয়ার খাল দিয়ে যাচ্ছে, ফলে বিলের পানি বের হতে পারছে না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন মাছ চাষের নামে নদী দখল করা একটি প্রভাবশালী চক্র গোপনে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে নিজেদের নামে নামপত্তন করেছে। এখন তা প্লট আকারে বিক্রি হচ্ছে। এই দখল উচ্ছেদ ও দায়ীদের শাস্তি দাবি করেছে স্থানীয়রা এবং পরিবেশবাদী সংগঠন বাপা।
স্থানীয়রা জানান, যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের ভাতুড়িয়া বাজার থেকে পূর্বদিকের সড়কটি চাঁচড়া দক্ষিণপাড়ার দিকে চলে গেছে। এ সড়কের কিছুদূর গেলেই দেখা মিলবে একটি কালভার্টের। কালভার্টটির দক্ষিণপাশে থৈ থৈ জলরাশি। আর উত্তরপাশে পুরোটা ভরাট করে প্লট বিক্রির সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। নদী ভরাট করে এখানে দখল করা হয়েছে প্রায় ১০ বিঘা জমি। এ জমির উত্তরপাশে নদী বহমান রয়েছে, সেখানে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এ বাঁধের ওপরে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে জিয়ার খাল। মূলত এ জিয়ার খাল দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দখল করে নেয়া হয়েছে মুক্তেশ্বরী নদী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুক্তেশ্বরী নদীটি যশোরের চৌগাছা উপজেলা থেকে এসে সদর উপজেলা হয়ে বিল হরিণায় গিয়ে শেষ হয়েছে। সর্পিলাকার এ নদী দিয়ে বর্ষাকালে যশোর সদর উপজেলা ও শহরের একাংশের পানি দক্ষিণমুখী হয়ে বিল হরিণায় গিয়ে পতিত হয়। আশির দশকের গোড়ায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় মুক্তেশ্বরী নদীর সঙ্গে একটি খাল খনন করা হয়। যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের চাঁচড়া দক্ষিণপাড়া থেকে এ খালটি পূর্বদিকে সতীঘাটা হয়ে ঢাকুরিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি ‘জিয়ার খাল’ নামে পরিচিত। আর এখান থেকে মুক্তেশ্বরী নদীটি আরো কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে গিয়ে বিল হরিণায় একাধিক খালে বিভক্ত হয়ে মিশে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, এ খাল কাটার পর থেকে মুক্তেশ্বরীর নিচের অংশ ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করতে শুরু করে প্রভাবশালীরা। কখনো ইজারা নিয়ে আবার কখনো দখল করে মাছ চাষ করা হলেও পানি প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। কিন্তু কয়েক মাস আগে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র ভাতুড়িয়া-নারায়ণপুর সড়কের কালভার্টের উত্তরপাশ থেকে জিয়ার খালের সংযুক্তমুখ পর্যন্ত মাটি ফেলে ভরাট করতে শুরু করে। পুরো এ অংশটি ভরাট করে এখন সেখানে প্লট বিক্রির সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।
চাঁচড়া দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা মোবারেক হোসেন বলেন, ‘রাস্তায় কালভার্ট আছে। কালভার্টের একপাশে নদী আছে; আরেক পাশে নেই। অন্ধ লোকও দেখলে বলবে এখানে নদী ছিল। কিন্তু এখন তা ব্যক্তিমালিকানার জমি বলে দাবি করা হচ্ছে।’
ভাতুড়িয়া পূর্বপাড়ার বয়োবৃদ্ধ তবিবর রহমান বলেন, ‘এ নদীতে পাট জাগ দিয়েছি, গরু-ছাগল গোছল করিয়েছি। নদীর পানি দিয়ে চাষ-বাস করেছি। এখন সেই নদী ভরাট করে প্লট বিক্রি করা হচ্ছে।
ভাতুড়িয়া নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজ আহমেদ জানান, ‘অনেক স্থানে নদীর পাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণ বা নদী দখল করে মাছ চাষের অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে পুরো নদীটাই দখল করে ভরাট করে নেয়া হয়েছে। তারা দাবি করছে, এ জমির মালিক তারা। কিন্তু নদীর জমি কীভাবে ব্যক্তিমালিকানা হয়; তা আমাদের বুজে আসে না।’
ভাতুড়িয়া পূর্বপাড়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ কাশেম মোড়ল জানান, আগে বর্ষার সময় উজানের পানি, যশোর শহরের পানি মুক্তেশ্বরী দিয়ে বিল হরিণায় এসে পড়ত। জিয়ার খাল কাটার পর সেই পানি দুই ভাগ হয়ে নদী ও খাল দিয়ে নিষ্কাশিত হতো। ওপরের পানির চাপ কমে গেলে বিলের পানি মুক্তেশ্বরী দিয়ে উঠে এসে জিয়ার খাল দিয়ে নেমে যেত। এখন মুক্তেশ্বরী মাঝ বরাবর দখল হয়ে যাওয়ায় ওপরের পানি শুধু জিয়ার খাল দিয়েই নেমে যাচ্ছে। কিন্তু বিলের পানি আর ওই খালে যেতে পারছে না। ফলে বিলের পানি এবং মণিরামপুরের উত্তরাংশের পানিতে বিল হরিণা এখন টইটম্বুর। এ জলাবদ্ধতায় হাজার হাজার বিঘা জমিতে এবার আর আমন ধান চাষ সম্ভব হবে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন নদীর এ অংশ ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করা চক্রটি গোপনে গোপনে অবৈধভাবে এ জমির শ্রেণী পরিবর্তন করেছে। এরপর জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তা নিজেদের নামে করে নিয়েছে। আর এখন সেই জমি বিক্রির চেষ্টা চলছে।
ভাতুড়িয়া এলাকার মাসুদ রানা বলেন, ‘ম্যাপেও মুক্তেশ্বরী নদী বিদ্যমান রয়েছে। অথচ তা ভরাট করে বিক্রির চেষ্টা চলছে। আর নদী ভরাটের খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের। বিলের হাজার হাজার একর জমি জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। বিল ছাপিয়ে পানি বাড়িঘরে প্রবেশ করছে। আমরা অবিলম্বে এ অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফেরত দেয়ার দাবি জানাই।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যশোর জেলা শাখার আহ্বায়ক খন্দকার আজিজুল হক মনি বলেন, ‘চাঁচড়ায় মুক্তেশ্বরী নদীর একটি অংশ পুরোটাই ভরাট করে প্লট বিক্রি চলছে। আর নদী দখলের কারণে জলাবদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে। আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই, অবিলম্বে এ দখল উচ্ছেদ এবং নদীর জমি জাল-জালিয়াতি করে দখলের পেছনে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
এদিকে, জমি বিক্রির সাইনবোর্ডে যে ফোন নম্বর দেয়া রয়েছে, সেটি যশোর রেজিস্ট্রি অফিসের এক সময়ের পিয়ন নূর ইসলাম নুরু'র। ওই ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে নুরু দাবি করেন, ‘ওই জমি ব্যক্তিমালিকানার। জমির মালিক ওই এলাকার জামাল, কামাল ও মুন্না। তাদের নামে দলিল আছে, নামপত্তন আছে। তাই তাদের পক্ষে তিনি জমি বিক্রি করছেন।’
তবে জমির মালিক হিসেবে যাদের নাম নুরু উল্লেখ করেন, তাদের ফোন নম্বর চাইলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই জমির সব কাগজপত্র আমাদের কাছে রয়েছে। ক্রেতাদের বৈধভাবে জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়া হবে।’
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানিয়েছেন, নদীর জমি ব্যক্তিমালিকানায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন
আপনি ও পছন্দ করতে পারেন
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
আর্কাইভ!
অনুগ্রহ করে একটি তারিখ নির্বাচন করুন!
দাখিল করুন