ডার্ক মোড
Friday, 31 January 2025
ePaper   
Logo
চট্টগ্রামে রেলের শত কোটি টাকার জমি গিলে খাচ্ছে টিকে গ্রুপ

চট্টগ্রামে রেলের শত কোটি টাকার জমি গিলে খাচ্ছে টিকে গ্রুপ

এম আর আমিন, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশ রেলের জমি উদ্ধারে কঠোর আইন থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগের অভাবে দখলদারদের কবলে রয়েছে হাজার হাজার একর জমি। মাঝে মধ্যে সচেতন জনগণ ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের জেরে কিছু জমি উদ্ধার হলেও তা আবার বেদখল হয়ে যায়-এমন মন্তব্য খোদ রেল কর্মকর্তাদের।

রেলওয়ের সম্পত্তির ওপর সবচেয়ে নজর বেশি থাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ গুলোর। রেলওয়ে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিনা অনমুতিতেই কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি নিজেদের মনে করে নিয়েছেন।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একসনা লিজ নিয়ে ওই জমি ছাড়াও আশপাশের রেলওয়ের মালিকানাধীন আরও সম্পদ স্থায়ীভাবে দখলে রাখতে নিজস্ব বলয়ে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করে জোর পূর্বক দখলে নিতে নানান ফন্দি ফিকিরে ব্যস্ত।

সীতাকুণ্ডের কুমিরা রেলওয়ে স্টেশনের পাশেই বড় কুমিরায় অবস্থিত দেশের ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী স্টিল মিলস। অভিযোগ উঠেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ থেকে এক দশমিক ৩৩ একর সম্পত্তি কৃষি জমি হিসেবে লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তাছাড়া ইজারা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ওই জমিতে লেবার শেড নির্মাণ, পুকুর ভরাট, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, নিজেদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে পুরনো মাদ্রাসা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া, শহীদ মিনার স্থানান্তর, কালো ধোঁয়া, দূষিত পানি নির্গমন ও জনবসতিস্থানে বিপদজ্জনক গ্যাস ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতিসাধন এবং নিজস্ব গুণ্ডা বাহিনী তৈরি করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্থানীয়দের বলপূর্বক ভূমিহীন করাসহ গুরুতর নানান অভিযোগ উঠে এসেছে কর্ণফুলী স্টিল মিলস’র বিরুদ্ধে।

সরেজমিনে প্রতিষ্ঠানটির পাশে বসবাসরত একাধিক বাসিন্দার সাথে কথা হলে তারা জানায়, কুমিরা এলাকার চিহ্নিত প্রভাবশালী মো. মহমিস রেজা এবং মোহাম্মদ আলীর নের্তৃত্বে একটি ভূমিদস্যু বাহিনী কুমিরা রেলওয়ে স্টেশনের আওতাধীন কোটি কোটি টাকার জমি দখলে নিয়েছেন।

তারা স্টেশনসংলগ্ন রেলের উল্লিখিত মূল্যবান জমিতে প্রকাশ্যে লোহা-টিন দিয়ে বেড়া দিয়ে ফেলে। বেআইনিভাবে মাটি ভরাট করতে থাকে। জোরপূর্বক কলোনি থেকে সাধারণ মানুষদের উচ্ছেদ করে দখলে নেয়। সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে অনেক কলোনিবাসী অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিয়ে এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে বারবার বিষয়টি অবহিত করলেও কার্যত কোন প্রতিকার নেই অভিযোগ স্থানীয়দের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যক্তি অভিযোগ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, মূলত ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী স্টিল মিলসের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে মরিয়া চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রুপটি।

রেলওয়ের মালিকানাধীন বিশাল এ সম্পত্তি নিজেদের দখলে নেয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা দিয়ে বাহিনীটি পালছেন ব্যবসায়ী গ্রুপটি।

তাদের এসব কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ বাঁধা দিতে গেলেই ভূমিদস্যুরা অস্ত্র হাতে তেঁড়ে এসে তাদের মেরে ফেলার হুমকিসহ নানান ভয়ভীতি দেখান বলেও অভিযোগ করেন স্থানীয় লোকজন।

স্থানীয় সুত্র জানিয়েছে, কৃষি লিজের জমিতে স্থায়ী স্থাপনা হিসাবে সেখানে সীমানা দেয়াল নির্মাণ করেছে টিকে গ্রুপ। বানানো হয়েছে ট্রাক চলাচলের রাস্তা। খনন করা হয়েছে পুকুর। টিনের বেড়া দিয়ে ভেতরে নির্মাণ করেছে পানির পাম্প।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিইও/ ৩৯৫- কৃষি/ কুমিরা/ ০৫/ ৭৪৭/ ৩৬১/ এ তাং ৩০/ ০৩/ ২০০৫ সালে সীতাকুণ্ডের কুমিরা স্টেশন এলাকায় রেল লাইনের পশ্চিম পাশে (কিমি.২৩/২ হইতে ২৩/৪) এর মধ্যে দুই প্লটে ১ দশমিক ৩৩ একর জমি কর্ণফুলী স্টিল মিল লিমিটেডের বিপরীতে কৃষি লাইসেন্স ইস্যু করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোবারক উল্যা। প্লট দুটির একটি ৪৮ হাজার ৪২০ বর্গফুট, অপরটি ৯ হাজার ৬০০ বর্গফুট।

রেল সুত্র জানায়, কৃষি লিজের চুক্তিপত্রের ৪ নম্বর শর্ত অনুযায়ী উক্ত জমিতে যে ফসলাদি জন্মে তার চাষাবাদ ছাড়া অন্য কোনো কাজ, বসবাসের জন্য কোনো ঘর দরজা তৈরি, দোকানপাট নির্মাণ, বৃক্ষাদি রোপণ বা বাগান তৈরি করা, পুকুর, নালা বা খাল খনন, রাস্তাঘাট, মসজিদ, মন্দির, শ্মশান, কবরস্থান কিম্বা অন্য কোনো কাজের জন্য ওই ভূমি ব্যবহার করা যাবে না।

যদি এই শর্তের লঙ্ঘন হয় তাহলে রেল প্রশাসন লাইসেন্স বাতিল করে এবং ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ আদায়ের অধিকার রাখেন। কিন্তু বিদ্যমান আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে টিকে গ্রুপ উক্ত জায়গায় নির্মাণ করেছে বাণিজ্যিক স্থাপনা।

এর আগেও কুমিরা স্টেশনের পাশে রেলের জলাশয় ভরাট করে কারখানা সম্প্রসারণের অভিযোগ উঠেছিলো ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ পেয়ে গেল বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি রেলের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জলাশয় ভরাটের সত্যতা পাই। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে জলাশয়টি ভরাট করে কারখানা সম্প্রসারণ স্থগিত করে যতটুকু দখল করেছিল, সেটি রেলকে বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হয় টিকে গ্রুপ।

এদিকে ইজারা চুক্তি ভঙ্গ করে লিজ নেওয়া কৃষিজমিতে লেবার শেড নির্মাণ করায় কর্ণফুলী স্টিল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালামের কাছে ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ব্যাখ্যা তলব এবং কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছিলো রেল পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় তৎকালীন ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা কংকন চাকমা।

সেসময়কার মিলের ব্যবস্থাপক মো, সাইফুদ্দিন চৌধুরী ব্যাখ্যা হিসেবে জানিয়েছিলেন করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে রেলের জায়গায় অস্থায়ী লেবার শেড নির্মাণ করা হয়েছে। স্থায়ী স্থাপনা নয়।

জমিগুলোর দীর্ঘমেয়াদী লিজ বা সাফ কবলায় পাওয়ার জন্য রেল পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আবেদন গ্রহণ না করলে স্থাপনা তুলে ফেলা হবে। আবেদনে সাড়া নেই তবে এখনও ঠাঁই দাড়িয়ে স্থাপনা।

অতচ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জবরদখলে থাকা রেল বিভাগের সম্পত্তি উদ্ধারে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছিলো।

সম্পত্তি উদ্ধারে প্রণীত আইনটি বাংলাদেশ রেলওয়ে স্থাবর সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) আইন-২০২১ নামে অভিহিত হয়েছে। এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের জন্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে।

আইনে আছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের যেসব ভূমি, ভবন, জলাশয়, গাছপালা ও স্থাপনাদি অথবা এর অংশবিশেষ যা রেল কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে দখলে রাখা হয়েছে তা নতুন আইন প্রয়োগ করে উদ্ধার করা হবে।

এ ছাড়া লাইসেন্স বা ইজারা বা বন্দোবস্তের বা ভাড়ায় যেসব সম্পত্তি রয়েছে তার মেয়াদ অবসানের পর তা আর কেউ দখলে রাখতে পারবে না। কিন্তু এর কার্যকর প্রয়োগ নেই বললেই চলে-এমন মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এক্ষেত্রে টিকে গ্রুপ কৃষি লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করেছে মন্তব্য করে বর্তমানে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা এবং রেলওয়ের সাবেক কর্মকর্তা নাছির জানালেন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

 এবিষয়ে জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চলের বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা (ডিইও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ’ কুমিরা রেল স্টেশনের পাশে রেলওয়ে কলোনীর জমিটি কর্ণফুলী স্টীলসহ কতিপয় ভূমিদস্যুরা দখলে নেয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। আমরা পুলিশ ও আরএনবির সহায়তায় গত বছরের ২৫ নভেম্বর উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে তারা আমাদের ওপর হামলা করে। এস্কেভেটরের ড্রাইভারকে আহত করেছে। বিষয়টি সিনিয়র কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এবিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা (সিইও) মো. মাহবুব উল করিম জানান, রেলের জমি অবৈধভাবে ব্যবহারের কোন সুযোগ নাই। কেউ ইজারা শর্ত ভঙ্গ করলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। তবে কুমিরা স্টেশন এলাকায় প্রকাশ্যে রেলের জমি দখলের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। আশা করছি শীঘ্রই আমরা কঠোর অবস্থানে যাবো এবং এ জমি পুরোপুরি উদ্ধার করে রেলের আওতায় আনা হবে।

এব্যপারে জানতে চাইলে কর্ণফুলী স্টীল মিলস লিমিটেডের জিএম মো. আব্দুল কাদের প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে মিটিংয়ের অযুহাতে পরে ফোন দিতে বলেন। পরে আবার কল দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন