ডার্ক মোড
Thursday, 08 May 2025
ePaper   
Logo
সাংবাদিকের হাঁটু ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি  ভুয়া বিএড সনদে প্রধান শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে

সাংবাদিকের হাঁটু ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি ভুয়া বিএড সনদে প্রধান শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে

 

 
মো: শাহ আলম মিয়া ,মিঠাপুকুর (রংপুর)প্রতিনিধি
 
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় নকল সরবরাহের সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকের হাটু ভেঙ্গে পঙ্গু করে দেয়ার হুমকিদাতা অধ্যক্ষ মাহেদুল আলমের বিরুদ্ধে ভুয়া বি.এড সনদে প্রধান শিক্ষক হওয়াসহ নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগ উঠার ছয় মাসেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি প্রশাসন।
 
মঙ্গলবার (৬ মে) বিকেলে অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিকাশ চন্দ্র বর্মণ। তবে অভিযোগপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে ইউএনওর পক্ষ থেকে জানানো হলেও তা প্রত্যাখান করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষক ও কর্মচারীবৃন্দ।
 
এবিষয়ে ভুক্তভোগী ২ শিক্ষক ও ১ কর্মচারী জানান, আমরা অভিযোগ প্রত্যাহার পত্রে স্বাক্ষর করিনি। ছয় মাস আগে রংপুর জেলা প্রশাসক, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলাম। আগের অভিযোগের বিচার পেলাম নাহ। নতুন করে কার ভরসায় অভিযোগ দিয়ে বিপদে পড়বো।
 
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়,উপজেলার পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে ২০০২ সালের মে মাসে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিও ভুক্ত হন মোঃ মাহেদুল আলম । এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক ৩ মার্চ ২০২২ ইং তারিখের অনলাইন ভিত্তিক অডিটে প্রত্যেক শিক্ষক ও কর্মচারীর যাবতীয় তথ্য অনলাইনে আপলোড করার পর দেখা যায় মোঃ মাহেদুল আলম ২০০০ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে বিএড পাস করেছেন। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০০২ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর ২০০৮ সালের মে মাসে তিনি বিএড স্কেল প্রাপ্ত হন ভুয়া সনদে। এবং ২০০০ সালে বি.এড পাস করে থাকলে ২০০৮ সালে কেনো বি.এড স্কেল গ্রহণ করলেন এমন প্রশ্ন উঠার পর অনুসন্ধানে জানা যায়,২০০৫ সালে বি.এড পাস কোর্সে মাহেদুল আলম ভর্তি হলেও তিনি পাস করতে পারেননি। 
 
অভিযোগে আরো জানা যায়, মাহেদুল আলম যোগদানের পরে ২০০৮ সালে প্রথম স্কেল গ্রহণ করেন। এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী ৮ বছর পরে টাইম স্কেল পাওয়ার নিয়ম থাকলেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে চার বছর পূর্বেই ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম টাইম স্কেল বেতনকোড- ৯ নেন। নিয়ম অনুযায়ী এই স্কেল ২০১৬ সালে পাওয়ার কথা ছিলো। এভাবে এমপিও নীতিমালা ভঙ্গ করে তিনি সরকারের অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করেন।
 
এদিকে ২০১৬ সাল হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষক কর্মচারীর টিউশন ফি আত্মসাৎ এর অভিযোগ পাওয়া গেছে  মাহেদুল আলমের বিরুদ্ধে। শুধুমাত্র ২০২২ ও ২০২৪ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম তুহিনের স্বাক্ষর জাল করে তৎকালীন সভাপতি আমিরুল ইসলামের অগোচরে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা শিক্ষক কর্মচারীর টিউশন ফি উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। এঘটনায় প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন সভাপতি আমিনুল ইসলাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর ২৮ অক্টোবর ২০২৪ সালে অভিযোগ দেয়ার ছয় মাসেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি উপজেলা প্রশাসন।
 
এছাড়াও ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের শিক্ষাবোর্ড থেকে ফেরত অব্যয়িত অংশের অর্থ ফেরত না দিয়ে ৪৭ জন শিক্ষার্থীর ১৯,১৩০ টাকা আত্মসাৎ করেন। এব্যাপারে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪ সালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দিলেও অদ্যাবধি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি প্রশাসন।
 
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই স্কুলে কর্মরত একাধিক শিক্ষক কর্মচারী জানান, অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম মিঠাপুকুর উপজেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের থানা কমিটির সদস্য ও এমপি পুত্র আওয়ামীলীগ নেতা রাশেক রহমানের ঘনিষ্ঠভাজন হওয়ায় বিগত সরকারের আমলে একচ্ছত্রভাবে লুটপাট চালিয়েছেন। বিগত সময়ে উপজেলার ভাংনী ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যান পদে নৌকা মার্কার পদ প্রত্যাশীও ছিলেন মাহেদুল আলম। সরকার পটপরিবর্তনের পর অর্থের বিনিময়ে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের ম্যানেজ করে তার নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দা মিঠাপুকুর ও পীরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আব্দুল মমিন মন্ডলের ছত্রছায়ায় এখনো বেপরোয়া এই প্রধান শিক্ষক।
 
অভিযোগ রয়েছে শিক্ষক ও কর্মচারীর টিউশন ফি আত্মসাৎ ছাড়াও ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে রংপুর জেলা পরিষদ কর্তৃক বরাদ্দকৃত ১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ ও স্কুলকে কলেজে উন্নীত করে একাই ৩৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ। কোন প্রকার ছুটি না নিয়ে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্কুলে না এসে বেতন ভাতা উত্তোলন, ভুয়া রেজিষ্ট্রেশন করে বাউবি শিক্ষার্থীদের নিকট অর্থ আত্মসাৎ। এছাড়াও ২০২৪ ইং সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার শিক্ষক কর্মচারীদের সম্মানী না দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, প্রতিষ্ঠানের ০৫ জন শিক্ষকের কাছ থেকে মন্ত্রণালয়ের অডিট খরচের নামে জোর পূর্বক এক লাখ টাকা আত্মসাৎসহ সুনির্দিষ্ট ১৪ টি অভিযোগে গত ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং তারিখে রংপুর জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ওই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র শিক্ষক মোঃ মাকসুদুর রহমান, রেজাউল করিম,অফিস সহায়ক হায়দার আলী ও নৈশপ্রহরী গোলজার হোসেন।
 
এদিকে অধ্যক্ষ মাহেদুল আলমের নামে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরে অভিযোগকারীদের আপত্তিতে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে বাদ দিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পক্ষ থেকে তদন্তভার দেয়া হয় মিঠাপুকুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ হাকিবুর রহমানকে। তদন্ত শুরুর পরেই চাহিদামাফিক তদন্তকারী কর্মকর্তাকে কাগজপত্রাদি সংগ্রহ করার পরেও অভিযোগকারীকে কয়েকদিন পর মীমাংসার জন্য বলে তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
 
এবিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষক মাকসুদুর রহমান ও রেজাউল করিম জানান,১৪ টি গুরুতর অভিযোগ এনে আমরা অভিযোগ দায়ের করেছিলাম। বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগের পরেও আমরা অভিযোগ প্রত্যাহার করিনি। ছয় মাসেও তদন্ত করেনি উপজেলা প্রশাসন। উল্টো আমাদের মীমাংসা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।প্রধান শিক্ষক পদে থাকাকালীন এই অভিযোগ গুলোর সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব নয়। আমরা অভিযোগ দিয়ে নিজেরাই এখন বিপদে আছি। এবিষয়ে বক্তব্য দিয়ে নতুন করে বিপদে পড়তে চাই না।
 
আরেক অভিযোগকারী অফিস সহকারী হায়দার আলী বলেন,আমরা অভিযোগ প্রত্যাহার করিনি। শুধুমাত্র নৈশ প্রহরীর চাকুরির মেয়াদ শেষ জন্য সে আপস করেছে।অভিযোগ করে তো ছয় মাসেও কোন ন্যায় বিচার পেলাম নাহ। ছোট চাকুরি করি। অধ্যক্ষের অনেক লোকজন। তার কিছু হবে বলে মনে হয় নাহ।
 
এবিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মিঠাপুকুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ হাকিবুর রহমান জানান, ইউএনও স্যারের পক্ষ থেকে আমাক তদন্তে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো।কিছুদিন পরে আমাকে জানানো হয় বিষয়টি সমাধান হয়েছে এটা আর তদন্ত করতে হবে না।যেহেতু বিষয়টি আমার দপ্তরের অন্তর্ভুক্ত নয় ও আমাকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে স্যার অব্যাহতি দিয়েছেন।এজন্য আর তদন্ত করা সম্ভব হয়নি।
 
অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মাহেদুল আলমের সঙ্গে  এবিষয়ে কথা বলতে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে কল রিসিভ করলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর  তিনি সরাসরি কথা বলবেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে কল দিলে তিনি আর রিসিভ করেননি।
 
মিঠাপুকুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল মমিন মন্ডল অধ্যক্ষ মাহেদুল আলমকে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি মিঠাপুকুর উপজেলার পাশাপাশি পীরগঞ্জ উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের দায়িত্ব পালন করায় ব্যস্ততার কারণে মোঃ মাহেদুল আলমের অভিযোগ গুলোর বিষয়ে তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। এখন তদন্ত শুরু করা হবে। ইতিমধ্যে পরীক্ষা পরিচালনা নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে অনিবার্য কারণবশত তাকে কেন্দ্রসচিব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ও চুক্তিতে নকল সরবরাহের ঘটনায় শোকজ করে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
 
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিকাশ চন্দ্র বর্মণ জানান,অধ্যক্ষ মাহেদুল আলমের বিরুদ্ধে এর আগে শিক্ষক কর্মচারীদের পক্ষ থেকে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিলো। তারা পরবর্তীতে আবেদন নিয়ে ওই অভিযোগটি তুলে নেন। অভিযোগকারীরা অভিযোগ প্রত্যাহার করেনি মর্মে অভিযোগ করেছেন প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন যদি আবার নতুন করে অভিযোগ দায়ের করে তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
 
উল্লেখ্য ২০০২ সালের মে মাসে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিও ভুক্ত হন মোঃ মাহেদুল আলম। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য রাশেক রহমানের বিশেষ সুপারিশে ও রংপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডলের সরাসরি হস্তক্ষেপে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ২০২২ সালে এইচএসসি পাঠদানের অনুমতি নিয়ে অধ্যক্ষ বনে যান মাহেদুল আলম।
 
এদিকে গত সোমবার (২১ এপ্রিল) বিকেলে "চুক্তিতে নকল সরবরাহের প্রতিযোগিতা এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে' শিরোনামে দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রচারিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পরেই ওইদিন সন্ধ্যায় কেন্দ্রসচিব অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম মুঠোফোনে সাংবাদিক খন্দকার রাকিবুল ইসলামকে হাটু ভেঙ্গে পঙ্গু করে দেয়ার হুমকিসহ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এছাড়াও ওই রিপোর্টের জন্য সাংবাদিকদের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেয়ার হুমকি প্রদান করে। এঘটনায় হুমকির কল রেকর্ড বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয় ও সারাদেশের গণমাধ্যমকর্মী এবং সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে অপসারণের দাবি জানান।
 

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন

আপনি ও পছন্দ করতে পারেন