ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেলসের সুরম্য দ্বিতল বিশিষ্ট বাংলো এবং ব্রিটিশ প্রকৌশলীর স্মৃতিস্থান এখনও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে
টি.এ পান্না ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি
১৮৮৯ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ভারত সরকার আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সাথে কলকাতার যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করেন। ১৮৯০ সালে শিলিগুড়ি মিটারগেজ রেলপথ স্থাপিত হলে পাকশীতে প্রমত্তা পদ্মার এক তীরে সাড়াঘাট ও অন্য তীরে দামুকদিয়া ঘাটের মধ্যে চলাচল শুরু হয় রেল, ফেরি ও স্টিমার। এরপর তত্কালীন প্রকৌশলী জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেইলস ও ফ্রান্সিস স্পিংয়ের জন্য পাকশী পদ্মানদীর তীরে নির্মাণ করা হয় দ্বীতল বিশিষ্ট আকর্ষনীয় এক বাংলো। এই ভবনে বসেই তারা হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের চুড়ান্ত নক্সা তৈরীর কাজ সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে সেতু নির্মাণের মঞ্জুরী লাভের পর বৃটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইল্স সেতু নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯০৯ সালে ব্রীজ নির্মাণের সার্ভে শুরু হয়। ১৯১০-১১ সালে পদ্মার দুই তীরে সেতু রক্ষার বাঁধ নির্মাণ হয়। ১৯১২ সালে ব্রীজটির গাইড ব্যাংক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পাশাপাশি সেতুটির গার্ডার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। অতঃপর সেতুটির গার্ডার নির্মাণের জন্য কূপ খনন করা হয়। ২৪ হাজার শ্রমিক দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৫ সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তৎকালীন ভাইসরয় ছিলেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। তাঁর নামানুসারে ব্রীজটির নামকরণ করা হয় হার্ডিঞ্জ সেতু। সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ৩ কোটি ৫১ লক্ষ ৩২ হাজার ১ শত ৬৪ টাকা। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮ শত ফুট। সেতুটিতে ১৫টি স্প্যান আছে। সেতুটি ঈশ্বরদী ভেড়ামারা সীমানায় পদ্মানদীর উপর অবস্থিত। ১৯১০ সালে সেতু নির্মাণের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে তাদের তৈরী নকশায় ব্রেইন্স ওয়ালটি অ্যান্ড ক্রিম নামের প্রতিষ্ঠান এ রেল সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে পাকশী পদ্মা নদীর ওপর । বাংলোতে বসেই তিনি হার্ডিঞ্জ সেতুর নকশা জরিপ এবং নির্মাণ কৌশল উদ্ভাবন করেন। বাংলোটিও তাই কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। খুব সহজেই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে এটি।
কিন্তু সে সময় পদ্মার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এই দুরূহ কাজ করতে গিয়ে বিশ্বে প্রথম রিভার ট্রেনিং ও গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয় পদ্মার উভয় পাড়ে। প্রায় ৮ কিলোমিটার উজান থেকে গাইড ব্যাংক বেঁধে এনে ১৯১২ সালে শুরু হয় রেল সেতুর কাজ। এরপর নরম পলিমাটিতে স্প্যান নির্মাণ ছিল আরেকটি দুরূহ কাজ। রিভার বেড বা নদী শয্যার নিচে ১৯০ থেকে ১৬০ ফুট গভীরতায় কূপ খনন করে স্থাপিত হয় স্প্যান। এভাবে প্রতিটি ৫২ ফুট উচ্চতার ১৫টি স্প্যান ও দু’পাশে শক্ত কাঠামোর ল্যান্ড স্প্যানের ওপর ৫ হাজার ৮৯৪ ফুট দীর্ঘ রেল সেতু নির্মাণ করা হয়, যা আজ এক অমর কীর্তি হিসেবে স্থান পেয়েছে। তবে যে কোন অমরকীর্তির স্বীকৃতি পেতে হলে প্রথমে সবচেয়ে যে বিষয়টির প্রয়োজন দেখা দেয় সেটি হলো চুড়ান্ত হিসাব ও অসাধ্য নক্সার প্রয়োজন হয়। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি মালবাহী বগি নিয়ে একটি ইঞ্জিন সেতু অতিক্রম করে।
জানা গেছে, সোনা মিয়া নামে এক ট্রেন চালক প্রথম ইঞ্জিন নিয়ে পাড়ি দেন সেতুটি। এরপর ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ তৎত্কলীন ভাইস লর্ড হার্ডিঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে সে সময়ের বৃহত্তম রেল সেতুটির উদ্বোধন করেন। সেই থেকে প্রথম ডবল লাইনের এই রেল ব্রিজের নাম হয় হার্ডিঞ্জ সেতু। ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেইলস ও ফ্রান্সিস স্পিংয়ের দ্বীতল বিশিষ্ট আকর্ষনীয় বাংলোর পাশাপাশি পাকশী এলাকায় গড়ে তোলা হয় পাকশী বিভাগীয় অফিস,রেলওয়ে কলোনী,আব্দুস সাত্তার মিলনায়তন,হাসপাতালসহ আরও কতকিছু। একই সাথে বিভাগীয় অফিস এরঅকা ঘিরে গোটা রেল শহরে লাগানো হয় কৃষ্ঞ চূড়ার গাছ। গাছগুলার বয়স প্রায় হার্ডিঞ্জ সেতুর সমসাময়িক হবে। প্রতি বছর লাল কৃষ্ঞচূড়া ফুলে এলাকাকে আকর্ষনীয় করে তোলে। যাখেুব সহজেই যে কোন বয়সী মানুষকে আকৃষ্ট করে।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রূপসা-বাগেরহাট সেকশনে চালু হওয়া প্রথম ন্যারোগেজ এর একটি ট্রেন-ইঞ্জিন ও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে হার্ডিঞ্জ সেতুতে নিক্ষিপ্ত বোমার অংশবিশেষ রাখা হয়েছে যা রেলের ও মুক্তিযুদ্ধের ইতহাস আজও বহণ করে চলেছে। এক কথায় রেলের বিভাগীয় অফিসের সামনে রাখার কারণে অফিসটিও আকর্ষনীয় হয়েছে দর্শনার্থীদের কাছে। বিজয় অর্জনের মাত্র ৫ দিন আগে, ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমার আঘাতে দ্বাদশ স্প্যানটি দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে পদ্মা নদীতে পরে যায় এবং নবম স্প্যানটির নিচের অংশ মারাত্মক ভাবে দুমড়ে যায়। ফলে উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে সাড়া দেয় বিশ্ব সংস্থা। ব্রিটিশ ও ভারত সরকার অতি দ্রুত হার্ডিঞ্জ সেতু মেরামত করে দেয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর হার্ডিঞ্জ সেতু দিয়ে পুনরায় রেল চলাচল শুরু হয়।
উইলিয়াম গেইলের নামানুসারে ‘গেলে কুঠি’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে বাংলোটি। এই বাংলোতে বসেই তিনি হার্ডিঞ্জ সেতুর নকশা জরিপ এবং নির্মাণ কৌশল উদ্ভাবন করেন। বাংলোটিও তাই কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। খুব সহজেই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে এটি। রেল বিভাগের শহর পাকশীর আরেক ঐতিহ্য ন্যারো গেজ রেলপথ। বর্তমান প্রজন্মের কাছে রেলপথের ব্রড গেজ ও মিটার গেজ অতি পরিচিত। একদিন এ দেশেই ছিল মিটার গেজ ও ছোট ন্যারো গেজ রেলপথ। পাকশী রেল বিভাগের অফিসের সামনে দেখা মেলে ন্যারো গেজ রেলপথ ও বাষ্পচালিত ইষ্টিম ইঞ্জিন। সবই কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। পাকশীতে আরও দেখা যায় চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ। এ বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল ভারতের প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষসহ বহু গুণীজনের। শিক্ষার প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠটি দেখতে গেলে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশের মুখে স্মৃতির দুয়ার খুলে নিয়ে যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ রূপপুর বাজারেরই এক কড়ইতলায় কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতেন আশপাশের গ্রামের মানুষ।
সেই থেকেই বিবিসি বাজার নামে আজও পরিচিত হয়ে আছে বাজারটি। এছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলীয় পাকশী বিভাগীয় অফিস, ধ্বংস হওয়া উত্তরবঙ্গের কাগজ কল, ইপিজেড ও ঐতিহাসিক ভারতবর্ষের ফুরফুরা খানকা শরীফ,রেলওয়ে পুলিশ লাইন,আর্মি বেইজ ক্যাম্প,পাকশী কলেজ এবং পাকশী রিসোর্ট। রূপপুর পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, বাংলাদেশ সুগারক্রপস্ গবেষনা ইনষ্টিটিউট বিএসআরআই, ঈশ্বরদী ইপিজেড, ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন, ইত্যাদি। আরও দেখার মতো রয়েছে ভেড়ামারা ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উৎপাদন কেন্দ্র, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ জিকে সেচ প্রকল্প। হার্ডিঞ্জ সেতু ঈশ্বরদী উপজেলাধীন পাকশী ইউনিয়নে অবস্থিত। হার্ডিঞ্জ সেতু ঈশ্বরদী উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। ঈশ্বরদী উপজেলা সদর হতে প্রায় ৮ কিঃ মিঃ দক্ষিণে পাকশী ইউনিয়নে পদ্মা নদীর উপর সেতুটি অবস্থিত।
নগর-মহানগরের কোলাহল থেকে অনেক দূরের এক পিকনিক কর্নার পাকশীর সবুজ পল্লী। এটি শুধু পিকনিকের জন্য নয়, হাজারও পর্যটক ও ব্রিটিশ প্রকৌশলীদের বাস্তব ইতিহাসের নাম। নির্মল আনন্দ আর বিনোদনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই নাম। বাংলাদেশসহ বিদেশী মানুষের কাছে এই পাকশী পিকনিক কর্নার, প্রকৃতির রূপতিলক ও ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেলসের কর্মজীবনের স্মৃতিস্থান বলে পরিচিত। এখানে শীত মৌসুমে বেশি আর বছরের অন্যান্য মৌসুমেও অসংখ্য দেশী-বিদেশীদের ভিড় জমে। ঈশ্বরদী শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে পাকশী ইউনিয়নের ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ সেতুর পাদদেশে ও প্রমত্তা পদ্মা নদীর কোলঘেঁষে এই পাকশী নামক সবুজে ঘেরা ছোট শহরটির অবস্থান। প্রায় ৩ হাজার একর জমির ওপর পাকশী শহর অবস্থিত। বিভাগীয় অফিসের সামনে রাখা ছোট স্টিম ইঞ্জিনটি পর্যটকদের বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে যায় দূর থেকে দূরান্তরে। পাকশীর সবুজের সমারোহে বিমানে উড্ডয়নের সময় মনে হবে সবুজে ঘেরা শালিক পাখির বাসা, মাঝখানে ফুটবল মাঠকে উঠোন আর হার্ডিঞ্জ সেতুকে শালিক পাখিদের পায়ে হাঁটা কোন কাঠের তৈরি সেতু মনে হবে। পাকশী শহরের প্রবেশ পথগুলোর সবই কোন না কোন কারুকার্য খচিত।