
ইতিহাস, বাস্তবতা ও গণতান্ত্রিক ন্যায্যতার বিশ্লেষণ; কুমিল্লা-১০ নির্বাচনী আসন নিয়ে কিছু কথা
মোহাম্মদ আলাউদ্দিন
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মূল ভিত্তি হলো জাতীয় সংসদের আসনভিত্তিক কাঠামো। এই কাঠামোর উদ্দেশ্যই হলো দেশের প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব দেওয়া, যাতে তাদের সমস্যা, চাহিদা ও উন্নয়ন প্রস্তাবনা জাতীয় স্তরে পৌঁছায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নাঙ্গলকোট উপজেলা সেই কাঠামো থেকে বহুদিন ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে একাধিকবার আসন পুনর্বিন্যাস হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় আসন বাড়ানো কিংবা ভৌগোলিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে প্রশাসনিক ভারসাম্য আনার উদ্দেশ্য থাকলেও বাস্তবে দেখা যায়, অনেক সময় রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন বাতিল করে সেটিকে বিভক্ত বা সংযুক্ত করা- যা গত দেড় দশক ধরে এক অসন্তোষের জন্ম দিয়ে রেখেছে।
১৯৮৬ সালে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলাটিকে একটি পৃথক সংসদীয় আসনে রুপান্তিত করা হয়। যা কুমিল্লা-১১ আসন হিসাবে সংসদীয় আসনের মানচিত্রে স্থান পায়। এ হিসাবে পর পর কয়েকটি সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নাঙ্গলকোটবাসী সরাসরি তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পেত এবং সংসদে তাদের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হতো। কিন্তু ২০০৮ সালের আসন পূনর্বিন্যাসের কারণে নাঙ্গলকোটের উন্নয়নে কালো ছায়া পড়তে থাকে। কুমিল্লায় আসন কমাতে গিয়ে কুমিল্লা-১১ আসনটি কুমিল্লা-১০ এ পরিণত করে নাঙ্গলকোটের সাথে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন যুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে পুরো সদর দক্ষিণ উপজেলাকে এ আসনে যুক্ত করা হয়। এরপর এ আসনে লালমাই নামক আরো একটি নতুন উপজেলা যুক্ত হয়। ফলে এ আসনের সীমানা পরিধি হয় তিনটি উপজেলা নাঙ্গলকোট, লালমাই ও সদর দক্ষিণ। এতে সংসদীয় আসনের ভৌগলিক সীমা রেখা হয়ে যায় অন্তত ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ। তিনটি উপজেলার মিলে এ আসনের ভোটার সংখ্যা ৬লক্ষ ২১ হাজার ৯শত ২২ জন। এর মধ্যে শুধু নাঙ্গলকোট উপজেলাতেই ভোটার সংখ্যা রয়েছে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৭শত ২৮ জন। নির্বাচনের আগে চুড়ান্ত ভোটার তালিকায় এর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
আসনটির এলাকা নোয়াখালীর সেনবাগ এবং ফেনীর দাগনভূঞার পাশ থেকে কুমিল্লা শহরের কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশাল এলাকা জুড়ে সংসদীয় আসন হওয়ায় বিগত দিনে উন্নয়ন কর্মকান্ডে ব্যাপক অনিয়মসহ দেখা দিয়েছিল স্থবিরতা। উন্নয়নে সৃষ্টি হয়েছিল চরম বৈষম্য। পিছিয়ে পড়েছে আত্মসামাজিক উন্নয়ন। জনসাধারণ বিভিন্ন কাজ কর্মে সংসদ সদস্যকে কাছে পেতেও অনেক ভোগান্তি শিকার হতে হয়েছেন। এদিকে নাঙ্গলকোটের সাথে লালমাই এবং সদর দক্ষিণ উপজেলার কোন যাতায়াত বা ভৌগলিক সীমা রেখা নেই। নাঙ্গলকোটের যাতায়াত বা ভৌগলিক সীমা রেখা রয়েছে নাঙ্গলকোট- লাকসাম- কুমিল্লা- ঢাকা বা নাঙ্গলকোট টু চৌদ্দগ্রাম- ঢাকা- চট্রগ্রাম। এতে নাঙ্গলকোটের সাধারণ জনগণ এবং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ফলে দীর্ঘদিন থেকে এ আসনটি পুর্বাবস্থায় ফিরে ফেতে নাঙ্গলকোট উপজেলাবাসী আন্দোলন সংগ্রাম, প্রতিবাদ সমাবেশ, নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন। এদিকে এ আসনটি ফিরে ফেতে নাঙ্গলকোটের সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ¦ আবদুল গফুর ভূঁইয়া ২০১৩ সালে মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন নং ৭১৩২/১৩ দাখিল করেন। মহামান্য হাইকোর্টে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ এর রায় প্রদান করেন। রায়ের খসড়া গেজেট অনুযায়ী নাঙ্গলকোটকে একটি স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন হিসাবে নির্ধারণ করা হয়। এরপরও বিগত পতিত সরকারের নির্বাচন কমিশন রহস্যজনক কারণে কুমিল্লা-১১ (নাঙ্গলকোট) আসনটি পুর্বাবস্থায় ফিরে দেওয়ার কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি।
এই সিদ্ধান্তটি একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে, অন্যদিকে তিনটি ভিন্ন ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতাকে একত্র করে একটি অকার্যকর এবং ভারসাম্যহীন রাজনৈতিক ইউনিটে পরিণত করে। এতে উন্নয়ন বরাদ্দ, প্রশাসনিক নজরদারি এবং নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসুবিধা সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্বে এসেছে, যা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর গঠিত হয়েছে। দেশের মানুষ আশা করেছিল, এই কমিশন জনআকাঙ্খাকে সম্মান জানাবে, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পূর্বের ভুল শুধরানোর বদলে তারা নতুন আরেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন কুমিল্লার লাকসাম ও লালমাই উপজেলাকে নিয়ে নতুন কুমিল্লা-৯, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে নতুন কুমিল্লা-১০ এবং কুমিল্লা সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলাকে নিয়ে নতুন কুমিল্লা-১১ সংসদীয় আসনের গঠনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসির ওয়েবসাইটে নির্বাচনী আসন বিন্যাসের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তালিকাটি ছড়িয়ে পড়লে কুমিল্লার সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোর জনমনে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। যা জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টু মারলেই দেখা যায়।
নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ এ দুই উপজেলার মানুষের সংস্কৃতি, সমস্যা, প্রশাসনিক কাঠামো ও উন্নয়ন চাহিদা এক নয়। নাঙ্গলকোটের মানুষ পৃথক পৃথক সংসদীয় আসনের দাবিতে বহুবার গণস্বাক্ষর, মিছিল, মানববন্ধন ও আবেদনের মাধ্যমে দাবি জানিয়েছে। মনোহরগঞ্জের মানুষ লাকসামের সাথেই থাকতে চায়। অথচ সেসব দাবিকে পাশ কাটিয়ে একটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ শুধু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বহীনতাই নয়, বরং জনগণের সঙ্গে এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতারণা।
নাঙ্গলকোটবাসী আর কোনো ছলচাতুরি চায় না। তারা চায় একটি স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন, যেখানে তাদের সমস্যাগুলোর সরাসরি প্রতিফলন ঘটবে। যেখানে একটি এলাকার সাংসদ শুধু কাগজে নয়, বাস্তবেও এলাকার সন্তান হবেন। সংসদে গৃহীত উন্নয়ন বাজেট, সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবনায় নাঙ্গলকোট থাকবে দৃশ্যমান, লুকিয়ে নয়। নাঙ্গলকোট একটি জনবহুল, রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। নির্বাচন কমিশনকে স্মরণ রাখতে হবে- সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস একটি কারিগরি কাজ নয়, এটি গণতন্ত্রের ভিত্তি রচনার প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বপ্ন, চাহিদা ও দাবি সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করাটাই গণতান্ত্রিক ন্যায্যতা।
নাঙ্গলকোটের মানুষ চায় না কোনো বিশেষ সুবিধা। তারা চায় সমতা, ন্যায্যতা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ। নির্বাচনী আসন গঠন কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারের স্বার্থ নয়, এটি জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের কাঠামো। সেই কাঠামোতে যদি একটি বৃহৎ জনপদ বারবার উপেক্ষিত হয়, তাহলে গণতন্ত্র হবে কেবল কিছু নামধারী প্রতিনিধির খেলা।
নাঙ্গলকোটের দাবি আজ আর শুধু এক উপজেলার চাওয়া নয়! এটি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার একটি নৈতিক ও সাংবিধানিক পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় পাস করতে হলে নির্বাচন কমিশনের উচিত অবিলম্বে নাঙ্গলকোটকে তার হারানো অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।
সাংবাদিক ও সংগঠক
কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি- দৈনিক ঘোষণা
সম্পাদক- সোনালী দেশ ডটকম
মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন
আপনি ও পছন্দ করতে পারেন
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
আর্কাইভ!
অনুগ্রহ করে একটি তারিখ নির্বাচন করুন!
দাখিল করুন