১৭ বছর পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বিডিআর ফিরোজ মিয়া, বাড়িতে দেওয়া হয় সংবর্ধনা
মো. সেলিম, নোয়াখালী
দীর্ঘ ১৬ শেষে ১৭ বছরের সময় কারাভোগের পর নিজ বাড়িতে ফিরেছেন বিডিয়ার বিদ্রোহ মামলায় জামিন পাওয়া ফিরোজ মিয়া। দীর্ঘ এ সময়ে তিনি হারিয়েছেন অনেক স্বজনদের। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে মুক্তির পর এখন চাকরি পুনর্বহালের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন ফিরোজ ও তার পরিবারের সদস্যরা। জামিনে মুক্ত পাওয়া বিডিআর সদস্য মো: ফিরোজ মিয়া জেলার কবিরহাট উপজেলার নরোত্তমপুর ইউনিয়নের পদুয়া গ্রামের মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে।
সাবেক বিডিআর বর্তমান (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের) সদস্য ফিরোজ মিয়ার গ্রামের বাড়িতে আজ দেওয়া হয়েছে বিডিআর কল্যাণ পরিষদ নোয়াখালী শাখার পক্ষ থেকে আনন্দময় এক সংবর্ধনা। সরকারের নির্দেশনায় ২০০৯ সালের ৩রা মার্চ বিডিআর ১৩ ব্যাটালিয়নের ল্যান্স নায়েক হিসেবে পিলখানায় যোগদান করেন ফিরোজ মিয়া। এরপর মর্মান্তিক পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছর ২৩ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় ৮ বছরের এক মেয়ে ও ৫ বছর বয়সী এক ছেলে সন্তান রেখে কারাবন্দী হতে হয় ফিরোজ মিয়াকে।
পরবর্তীতে ফিরোজ মিয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরসহ হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করা হয়। গত ২৩ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৬ বছর পর নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলায় তার নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। তবে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে অনেক স্বজনেকে হারাতে হয় তাকে।
অশ্রুসিক্ত কন্ঠে ফিরোজ মিয়া বলেন, আমি নিরপরাধ হয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর কারাগারে ছিলাম, এই সময়ে জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়েছি, আমার ছেলে মেয়েরা তাদের বাবার আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি আমার সন্তানদের আদর যত্ন করতে পারেনি। এখন আল্লাহর রহমতে বাহির হয়ে এসেছি, কিন্তু আমার সন্তানদেরকে কি করে খাওয়াবো, কিভাবে পড়ালেখা করাবো সেটা জানিনা, আমাদের তো এখন আর কোন ইনকাম নাই, এখন এই বয়সে কেউ কাজেও নিবেনা, আমি চাই আমাদের আগের মতো চাকরিতে ফিরিয়ে নিয়ে আমাদের সকল পাওনা মিটিয়ে দেয় অথবা পেনশনের আওতায় নিয়ে আমাদেরকে অন্তত চলার ব্যবস্থা করে দেয়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমার এটাই চাওয়া।
দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কারাগারে থাকায় ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণসহ পরিবারের হাল ধরেন ফিরোজ মিয়ার সহধর্মিণী নাজমুন নাহার। একদিকে স্বামীর মামলা পরিচালনার খরচ, অপরদিকে দুটি সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে অমানবিক কষ্ট করতে হয়েছে নাজমুন নাহারকে। বুঝতে শেখার আগে বাবা দূরে আছেন জানিয়ে বুকে কষ্ট চাপিয়ে বড় করতে হয়েছে ছেলে-মেয়েকে। টাকার অভাবে অনেক সময় তিনবেলা ঠিকভাবে খাবার যোগাতেও হিমসিম খেতে হয়েছে নাজমুন নাহারকে।
সরেজমিনে ফিরোজ মিয়ার বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, দীর্ঘ বছর পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফেরায় আনন্দের জোয়ার বইছে গ্রাম জুড়ে। দূর-দুরন্ত থেকে স্বজনরা ছুটে এসেছেন ফিরোজের সঙ্গে দেখা করতে। ১৬ বছর পর স্ত্রী সন্তানদের কাছে পেয়ে আনন্দের অশ্রুও ঝরছে ফিরোজের। ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন স্মৃতি বিজড়িত স্থানসহ বিভিন্ন স্বজন ও মায়ের কবর দেখতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। তবে সব কিছু কাছে পেয়েও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো নোয়াখালীর আরও কয়েকজন কারাগারে থাকায় পরিপূর্ণ আনন্দ নেই তার মনে, খুব দ্রুতই তাদেরও মুক্তি মিলবে এমনটাই আশা করছেন তিনি।
সদ্য জামিনে মুক্তি পেয়ে, মুক্ত আকাশের হাওয়া পেলেও সব কিছু হারিয়ে নিজের এবং পরিবারের সুখের খোঁজে চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অর্থনৈতিক দুঃচিন্তাগ্রস্ত ফিরোজ মিয়া।
সংবর্ধনা দিতে আসা কয়েকজন বিডিআর সদস্য জানান, আমরা আজ অনেক আনন্দিত, দীর্ঘদিন পরে হলেও আমাদের এই সদস্যকে আমরা আজকে দেখতে পারছি, আমরাও দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে বিভিন্ন মেয়াদ শেষে বাহির হয়ে আসলেও আমাদের অনেক ভাই আসতে পারে নাই, এখন আমাদের ফিরোজ ভাই সহ অনেকেই দীর্ঘ ১৬ বছর পর আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে, আমরা এতে খুবই আনন্দিত, তাই তাকে ফুলের সংবর্ধনা দিতে আসলাম এবং আমরা চাই অতিদ্রুত বাকিদেরকেও মুক্তি দেওয়া হোক, অন্যদিকে আসল অপরাধীদেরকে শাস্তি দেওয়া হোক।
বাবাকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরে ফিরোজ মিয়ার ছেলে ফজলুর রহমান সানজিত বলেন, ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি বাবা দূরে কোথাও আছেন। আমাদেরকে কখনোই ঠিকভাবে বলেনি বাবা কারাবন্দি। বুঝতে শেখার পরে জেনেছি বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বাবা কারাগারে আছে। ছোটবেলায় যখন দেখতাম স্কুলের বিভিন্ন বাচ্চাদেরকে তাদের বাবা এসে নিয়ে যায়, কিন্তু আমরা বাবার সেই আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। মায়ের সঙ্গে কান্নাকাটি করতাম আমাদের বাবা কেন আসেনা, কখন আসবে তা জানতে চাইতাম। দীর্ঘ বছর বাবাকে ছাড়া আমাদের পথ চলটা খুবই কষ্টের ছিল। মা একা আমাদেরকে মানুষ করেছে। তবে আমাদের বিপদের সময় নোয়াখালীর মানুষ বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
এসময় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করা বিডিআর সদস্য ল্যান্স নায়েক মানিক, সদ্য জামিন পাওয়া মো. আনোয়ার হোসেন, নায়েক সালা উদ্দিন, নায়েক মো. নুরুল হোসেন, যাবৎ জীবন সাজা নিয়ে কারাগাওে অবস্থানরত বিডিআর সদস্য নায়েক শেকান্তর আলির স্ত্রী আমেনা বেগম, আবুল হোসেন, আব্দুল বাকের রনি, ইমাম হোসেন, আব্দুল কায়ুম প্রমূখ।