ডার্ক মোড
Monday, 13 October 2025
ePaper   
Logo
রাষ্ট্র যখন ট্রাভেল এজেন্সি, জনগণ তখন কাস্টমার

রাষ্ট্র যখন ট্রাভেল এজেন্সি, জনগণ তখন কাস্টমার


ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক

রাষ্ট্র আজ যেন নিজের নামের আড়ালে একটি বিলাসী ভ্রমণ সংস্থা খুলেছে। শীর্ষ নেতৃত্ব আকাশে চোখ রাখে, হাতে লাল গালিচা, কাঁধে ফ্ল্যাশ, হাসিতে রাজকীয়তা। জনগণ? তারা নীরব কাস্টমার। তাদের করের টাকায় চলে বিদেশ সফর, কিন্তু আসনে বসার সুযোগ নেই। ট্যাক্স দিয়ে তারা শুধু দর্শক, আর রাষ্ট্রের জাহাজ উড়ছে আকাশের আলোয় ভেসে। এই ভ্রমণ যেন শুধুই ফটোসেশনের জন্য, অর্জনের নয়, শীর্ষ নেতৃত্বের প্রোটোকলের প্রদর্শনী।

প্রথম সফরে বিমানবন্দরই ছিল মূল থিয়েটার। ফ্ল্যাশের ঝলক, লাল গালিচা, পাঁচতারা হোটেলের অভ্যর্থনা—সবই অভিনয়ের মতো। রাতের রাজকীয় ভোজে লিপ্ত রাষ্ট্রনেতা হাসছে, আর দেশে সাধারণ মানুষ ট্যাক্সের বোঝায় নাকাল। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, ফটোশুট—সবই সফলতার বিকল্প মুদ্রা। অথচ এই বিলাসিতার ব্যয় দিয়ে অসংখ্য বিদ্যালয়, হাসপাতাল ও অবকাঠামো গড়া যেত।

চলল ১৪তম সফর। চার্টার্ড ফ্লাইট, হোটেল, নিরাপত্তা, আপ্যায়ন—সবই রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়, যা দিয়ে দেশের ক্ষুধা ও শিক্ষার ঘাটতি পূরণ করা যেত। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব হাসছে, লাল গালিচা, জনগণ? তারা পায় শুধু নিরব ভ্রমণপত্র। এটি তীর্যক বাস্তবতার প্রতীক, যেখানে নীতি হারায়, প্রটোকল জিতে যায়।

সফরসঙ্গী তালিকা নাটকের মতো। ৮০–১০০ জন, অনেকে নীতিনির্ধারণী নয়, তবে ঘনিষ্ঠতার ছায়ায় ভিআইপি। যোগ্যতা নয়, ঘনিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ বুঝতে পারে না—এই সফর তাদের নয়, শীর্ষ নেতৃত্বের প্রভাব প্রদর্শনের জন্য। দেশে সংকট, বিদেশে হাসি—দুই বাস্তবতার সমান্তরাল।

দেশের ভেতরের বাস্তবতা তীক্ষ্ণ। বাজার অস্থির, দ্রব্যমূল্য উর্ধ্বগতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার খাত ব্যয়বহুল। জনগণের জীবন ক্রমশ সংকটে। আর ঠিক তখনই রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যস্ত বিদেশ সফরের আড়ম্বরী বিলাসে। দুটি সমান্তরাল বাস্তবতা—একটিতে ঘামের গন্ধ, অন্যটিতে পারফিউমের সুবাস।

রাষ্ট্র যখন ফ্ল্যাশ, লাল গালিচা, ফটোশুটে ব্যস্ত, তখন প্রশ্ন আসে—রাষ্ট্রের অর্জন কী? নতুন চুক্তি? বিনিয়োগ? কৌশলগত অগ্রগতি? সবই শূন্য। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বলে “দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।” বাস্তবতার আয়তনে জনগণ ফাঁকা আশ্বাসে আটকে।

আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আড়ালে এই সফরগুলো কেবল রাজনৈতিক নাটক। বিদেশি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার, ব্যক্তিগত সংবর্ধনা—সব মিলিয়ে সফরনেতা মুখ্য। রাষ্ট্রের নৌকা উড়ছে দূর আকাশে, দেশের অভ্যন্তরীণ সমুদ্র অনাবিষ্কৃত। জনগণ কেবল দর্শক।।


কূটনীতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কূটনীতির নামে যদি বিদেশ ভ্রমণ নীতি ও জনগণের কল্যাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়, রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র থাকে না। জনগণের টাকায় বিলাসী সফর—থিয়েটার, যেখানে দর্শক শুধু করতালি দেয়, প্রশ্ন করতে পারে না।

ফটোসেশনের ঝলক, লাল গালিচা, ‘সফল সফর’-এর খালি বাক্য—এটাই জনগণের গন্তব্য। ১৪ মাসে ১৪টি সফর। সংখ্যার খেলা নয়, নীতিহীন প্রদর্শনীর প্রতীক। নীতি হারায়, প্রটোকল জিতে যায়, জনগণের আস্থা ক্ষয়।

নৌকার মাঝি আকাশে উড়ছে, ডেকে যাত্রীরা বুঝেছে—ভ্রমণ তাদের নয়। উন্নয়নের ঘাট দূরে, প্রটোকলের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে রাষ্ট্রের নৌকা। গন্তব্যহীন, ব্যয়বহুল, শূন্য অর্জনের সমুদ্র। এই নাটক চলছে, দর্শক জনগণ নিরব।

সবচেয়ে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ—যেখানে নীতি নেই, জনগণ দর্শক, আর রাষ্ট্র গর্বিত ফটোশেশনের ঝলকে। রাষ্ট্র যখন ট্রাভেল এজেন্সি, জনগণ হয় কাস্টমার। এই কাস্টমারের বিল পরিশোধ হয় কোটি কোটি টাকার ফ্ল্যাশে, হাসি ও ছবি তোলার বিলাসে, শূন্য অর্জনের আবরণে। তবে প্রশ্ন রয়েই যায় কতক্ষণ এই নাটক চলবে?


রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তক
ইমেইল : fokoruddincse@gmail.com

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন