
ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের নামকরণ ও বাজারের গোড়াপত্তনের ইতিহাস
মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার
অতীতকে স্মরণ করা বা জানা মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। শত বছর আগের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়নি অথবা জমিদার বা ইংরেজদের মাধ্যমে ইতিহাস লেখা হলেও সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটা অজানা। গবেষণা ছাড়া অনুমানের মাধ্যমে অনেক ভুল ইতিহাস জনশ্রুতি বা কিংবদন্তির মধ্যে রয়েছে। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের নামকরণ ও বাজারের গোড়াপত্তনের ইতিহাসের কিছু তথা উপাদান সংগ্রহ করে ময়মনসিংহের গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন (ACECC Association), ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি এন্ড লাইব্রেরি এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে আসছে। সরেজমিন ও গবেষণার মাধ্যমে শম্ভুগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধানী তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
ময়মনসিংহের বর্তমান শম্ভুগঞ্জের পরিচিতি:
শম্ভুগঞ্জ ময়মনসিংহ সদরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের অর্ন্তভুক্ত একটি টাউন। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র নদের উপর দু'টি সেতুর মাধ্যমে এটি ময়মনসিংহ মহানগরের বাকি অংশের সাথে যুক্ত। তাছাড়াও গত দুই বছর (২০২৩-২৪) থেকে দেশের বৃহত্তম স্টিল আর্চ ব্রিজের কাজ শুরু হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, নেত্রকোণা, সিলেট ও চট্টগ্রাম যাতায়াতের প্রধান সড়কের সংযোগস্থল শম্ভুগঞ্জে অবস্থিত। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির মাধ্যমে ১৮৮৫ সালে ময়মনসিংহের সঙ্গে ঢাকার রেল সংযোগ স্থাপন হয়। ১৮৯২ সালে ইংল্যান্ডে গঠিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি এদেশে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেওয়ার পর ময়মনসিংহ- গৌরীপুর- ভৈরব লাইনের সাথে ঈশ্বরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন, কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন ১৯১২ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে তৈরি করা হয় । ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব রেললাইন ছিল আসাম-বেঙ্গল রেল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাধীনে।১৯১৫ সালে চর কালিবাড়ি ও কেওয়াটখালী এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর রেলওয়ে সেতু নির্মিত হয়, যা ময়মনসিংহকে মোহনগঞ্জ, জারিয়া-ঝাঞ্জাইল এবং ভৈরবের সাথে যুক্ত করে। এই সেতু ও রেলপথ নির্মিত হওয়ার সময়ে শম্ভুগঞ্জ বাজারে একটি রেল স্টেশন স্থাপিত হয়।
ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ বাজারের উৎপত্তি ও নামকরণ ঃ
শম্ভুগঞ্জের নামকরণের বয়স প্রায় দুই শত বছর। গৌরীপুরের রামগোপালপুর জমিদার শ্রীশৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ বাজারের সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। বোকাইনগর বাসাবাড়ি এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর তিন ছেলে- শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র চৌধুরী। শ্যামচন্দ্র চৌধুরীর একমাত্র ছেলে শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী (মৃত্যু ১৮৫৪)। তার নামে শম্ভুগঞ্জ নামক প্রসিদ্ধ বাজার। শম্ভুগঞ্জ বাজার সম্বন্ধে লেখক ও জমিদার শ্রীশৌরীন্দ্র্রকিশোরের কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো –‘তিনি নিজ নামে একটি বৃহৎ বাজার স্থাপনা করিয়া সাধারণের প্রভূত উপকার সাধন করিয়াছেন। অদ্যাপি শম্ভুগঞ্জ নামক প্রসিদ্ধ বাজার তাহার কীর্তির পরিচয় দিতেছে।’ গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগন বাসাবাড়ি জমিদার শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী তার সেই কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন শম্ভুগঞ্জ বাজার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তার কীর্তি স্থায়ীভাবে ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসে। লেখকের মাধ্যমে শম্ভুগঞ্জের নামকরণের তথ্য আবিস্কৃত হয়ে বর্তমানে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে ইতিহাসের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতার অভাবই আমাদের দেশের অতীতের সাক্ষীগুলোর ধ্বংসের অন্যতম কারণ। অন্যান্য অঞ্চলের মতো ময়মনসিংহ জেলার প্রাচীন ম্যাগাজিন বা বই এবং পুরাকীর্তিগুলোও ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং কোথাও কোথাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
শম্ভুগঞ্জ বাজার গোড়াপত্তন ঘটার সময়ে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের বিবরণ ঃ
গৌরীপুরের উল্লেখিত সংগঠনের মাধ্যমে অজানাকে জানার জন্য ইতিহাসের অপ্রকাশিত অধ্যায়, তথ্যসূত্র, জনশ্রুতি, প্রাচীন মানুষের কথা, ঝরেপড়া অপ্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ, প্রাচীন দুর্লভ তথ্য ও আবিস্কৃত ও অনাবিস্কৃত মানচিত্র সংগ্রহ ও গবেষণার মাধ্যমে আপডেট ইতিহাস রচনা করা হয় । প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এসিক এসোসিয়েশন ও ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশনের সহযোগিতায় প্রতিবছর একটি স্বনামধন্য আঞ্চলিক তথ্যবহুল ম্যাগাজিন ‘পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স’ প্রকাশিত হয়। ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আড়াই শত বছর আগের কয়েকটি রেনেলের মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায় বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ ও মোমেনসিং পরগনার দিকে দৃষ্টি দিলে শম্ভুগঞ্জ বাজার নামে প্রসিদ্ধ স্থানের নাম পাওয়া যায় না। তবে পরানগঞ্জ, কাশিগঞ্জ, রাঘবপুর নামে প্রসিদ্ধ স্থানের নাম পাওয়া যায় । ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার আগে ময়মনসিংহ শহহের শেহড়া নামক স্থান থেকে সাহেব কাচারী (রাজগঞ্জ) অথবা গাজীপুর স্থান পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের প্রস্থতা ছিল। রেনেলের মানচিত্র থেকে গবেষক ও প্রত্নতাত্বিকরা অনুমান করেন যে, শম্ভুগঞ্জ বাজারটি ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝখানে চরের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। তৎকালী জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুীর মোমেনসিং পরগনার সীমানায় বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যস্থানে একটি ভূখণ্ড সৃস্টি হলে চরের অনেকস্থলেই এককালে জেলে, মাঝি ও কৃষকদের গ্রাম বা পাড়া সৃষ্টি হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এই জনপদকে ঘিরে একটি বাজার ও বন্দরের রূপ নেয়। ধারণা করা হয় যে, ইংরেজি ১৮২২ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে গৌরীপুরের বাসাবাড়ি জমিদার শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী তার নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত জনস্টন মানচিত্রে শম্ভুগঞ্জ স্থানটি উল্লেখ রয়েছে।
ময়মনসিংহ নামকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
শম্ভুগঞ্জের নামকরণ জানার আগে ময়মনসিংহ জেলা নামকরণের ইতিহাস জানা প্রয়োজন। এখনও ইতিহাসের অনেক সূত্র লুকিয়ে থাকতে পারে। বর্তমানে ময়মনসিংহের ইতিহাসের ধারণা মানুষের কাছে খুব একটা স্বচ্ছ নয়, তবে গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাসের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। সরকার বাজুহার নাম পরিবর্তন করে ১৭৮৭ সালের ১ মে মোমেনসিং পরগণার নাম দিয়ে জেলা প্রতিষ্ঠার পর জেলা শহর ও সদর থানা হিসাবে কালেক্টরির খারিজা তালুক ক্রয় করে আলাপসিং পরগণায় নাসিরাবাদ থানা (১৮২৫ এর আগে ), নাসিরাবাদ রেলওয়ে স্টেশন ও নাসিরাবাদ শহরের গোড়াপত্তন হয়। এর আগে ময়মনসিংহের ৫০০ বছরের অধিক প্রাচীন শহর বাইগনবাড়ী ও শেহড়া বন্দরে মোমেনসিং জেলার কাচারী বসত। রেনেলের মানচিত্র থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যতগুলো প্রাচীন মানচিত্র রয়েছে তা ঘাটলে তা দেখা যাবে মোমেনসিং থেকে ময়মনসিংহ কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল। বিংশ শতাব্দির জমিদারদের অনুরোধে ময়মনসিংহ জেলার নামে সদর থানা, রেলওয়ে স্টেশন, পোস্ট অফিস, পৌরসভার নাম পরিবর্তন করা হয়। যেমন সদর থানা নাসিরাবাদ পরিবর্তন করে জেলার নামে রাখা হয় সদর ময়মনসিংহ থানা। জমিদার আমলেও শহরটি দুই নামে পরিচিত ছিল। নাসিরাবাদ ও ময়ময়সিংহ বা মোমেনশাহী। বর্তমানে জেলা হিসেবে দুই নামে পরিচিত রয়েছে। সরকারীভাবে ময়ময়সিংহ ও বেসরকারীভাবে মোমেনশাহী। তাছাড়াও দুই পরগনার নামকরণ নিয়ে ইতিহাস ও কিংবদন্তি রয়েছে। হেসেন শাহ এর আমলে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ে দুই জন বীরযোদ্ধা ও সিংহ পুরুষ নামে সেনাপতি আলাপ শাহ ও মোমেন শাহ ছিলেন। তাদেরকে দেওয়ান বা রাজা সমতুল্য সম্মান দিয়ে এবং 'সিং' উপাধি দিয়ে দুই পরগনার নামকরণ করা হয়- মোমেনসিং ও আলাপসিং। এখানে 'সিং' এর অর্থ 'সিংহাসন বা রাজ্য অথবা রাজার উপাধি বোঝানো হয়েছে। যেমন 'সিংনছরত'।রেনেলের মানচিত্রে মোমেনসিং পরগনার দক্ষিণে রয়েছে হোসেনশাহী পরগনা। মানচিত্রের সূত্র ধরে বোঝা যায় পরগনাগুলোর নামকরণ হয়েছিল হোসেন শাহ এর আমলে। সরকার বাজুহার পূর্ব নাম ছিল ভারতের কুচবিহার ও আসামের বিশাল অংশ নিয়ে নাসিরাবাদ প্রদেশ। তখনকার সময়ে নাসিরাবাদ প্রদেশের শাসন কেন্দ্র ছিল কেন্দুয়া অথবা তাড়াইল উপজেলায়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে জাফরশাহী (জামালপুর) ও মোমেনসিং পরগনার অর্ধেক (১৬০ গন্ডা) জমিদারি পেয়েছিলেন গৌরীপুরের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রতাপশালী জমিদার ও নবাব সিরাজের পুত্র যুগল কিশোর রায় চৌধুরী। ময়মনসিংহ জেলার নামকরণে যুগল কিশোরের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তখনকার সময়ে ময়মনসিংহ জেলার নাম ছিল মোমেনসিং। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজদের পেশা-পদবী এবং বিভিন্ন চিঠি পত্র-তারিখসহ অফিসিয়্যাল ডকুমেন্ট থেকে ময়মনসিংহের ইতিহাস আরও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। যেমন the Collector of Momensing : W Wroughton, Collector— Momensing The 9th April 1788. ### Magistrate of Momensing, Mr. J. Straccy: 29th January.1802.### The East-India Register and Directory for 1819 (Second Edition) গ্রন্থে পদবীসহ ইংরেজদের নাম ও সন উল্লেখ আছে। যেমন Charles Smith, judge and magistrate of Momensing (1803), David Scott (2nd), Collector of Momensing (1805), Edward John Harrington, register of the zillah of Momensing (1808), Henry Moore, additional register of the zillah court of Momensing (1810), David Turnbull, surgeon, Momensing (1816); সুতরাং, রেনেলের মানচিত্র অথবা ইতিহাস থেকে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, মোমেনসিং পরগনার নামের সঙ্গে ইংরেজদের পেশা-পদবীর সাথে ’মোমেনসিং’ নামটি মিল থাকায় বোঝা যায় মোমেনসিং পরগনা থেকে ’ময়মনসিংহ’ নামের সৃষ্টি। তবে ইতিহাসের পাতা আরও ঘাটলে দেখা যায়, আলাপসিং পরগনায় নাসিরাবাদ শহরের গোড়াপত্তন ঘটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে। ময়মনসিংহের নতুন শহরের পরিকল্পনার সময়ে তালুকদার লস্কর মামুদের ছেলে নাসির উদ্দিন মোড়লের কাছ থেকে বিশাল জমি কালেক্টরির খারিজা তালুক হিসেবে ক্রয় করে নেন। তখন তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয় মোমেনসিং জেলার নাসিরাবাদ শহর। ইংরেজ আমল থেকে নাসির উদ্দিন মোড়লের বংশ বিস্তারকে কচ্চুয়া গোষ্ঠি নামে পরিচিত। বর্তমানে কচ্চুয়া গোষ্ঠির জনসংখ্যা ২০ হাজার অধিক।
শম্ভুগঞ্জ বাজারের প্রতিষ্ঠাতা শম্ভুচন্দ্র চৌধুরীর বংশপরিচয় বা তার জীবনীঃ
শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী বোকাইনগর বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা শ্যামচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন জাফরশাহী ও মোমেনসিং পরগনার প্রতাপশালী জমিদার। শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী তাঁর একমাত্র পুত্র।
ক) পিতার পরিচয় (শ্যামচন্দ্র চৌধুরী)
জমিদার শ্যামচন্দ্র চৌধুরী ব্রজেশ্বরী দেবীকে রিয়ে করেন। তার গর্ভে শম্ভুচন্দ্র নামে এক পুত্র ও কাশীশ্বরী, সোনামণি, অন্নপূর্ণা নামে তিন কন্যা জন্মে। রাজশাহী বিভাগের খাজুরা গ্রামের নিবাসী রুদ্রকান্ত লাহিড়ির সঙ্গে কাশীশ্বরী দেবীকে বিয়ে দেওয়া হয় । গাজীপুরের কাশিমপুর নিবাসী মতিকান্ত চৌধুরি সোনামণি দেবীকে বিয়ে করেন। অপর কন্যা অন্নপূর্ণ দেবী অবিবাহিতা অবস্থাতেই মৃত্যুর কবলে পড়েন । তিনি তার দুই কন্যার বিবাহের যৌতুক হিসেবে যথাযোগ্য তালুক উপহার দিয়েছিলেন। :শ্যামচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী তার পিতার জমিদারির সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। তিনি অতি ধীর এবং কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। পিতার একমাত্র পুত্র হিসেবে শম্ভুচন্দ্রের যত্ন ও আদরের অভাব ছিল না। শিক্ষা লাভের কোনও ব্যাঘাত হয়নি। তার অমায়িক ব্যবহারে, ন্যায় বিচারে, সুশাসনে প্রজাবর্গের সুখশান্তির মাধ্যমে জমিদারিরও বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি।
খ) শম্ভুচন্দ্রের আত্মসম্মানবোধের দৃষ্টান্ত :
শম্ভুচন্দ্রের আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রবল ছিল। একটি ঘটনায় তার বিশেষরূপে প্রমাণিত হয়েছে। পূর্বে কোম্পানির প্রচলিত নিয়মানুসারে প্রত্যেক জেলায় রাজস্ব আদায়ের বার্ষিক বন্দোবস্তের একটি উৎসব হত। তখন মোমেনসিং পরগণার জমিদারদের রাজস্ব দেওয়ার সর্বপ্রথমে গৃহীত হওয়ার প্রথা ছিল। ঘটনাক্রমে একবার মোমেনসিং পরগণার টাকা শহরে পৌঁছতে দেরি হওয়ার কারণে কালেক্টর সাহেব অন্য পরগণার টাকা প্রথম গ্রহণ করেন। শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী গৌরীপুর হতে নাসিরাবাদ শহরে পৌঁছার পর এই বিষয়ে জ্ঞাত হলেন। তিনি নাসিরাবাদ পুণ্যাহ উৎসব অনুষ্ঠানে দেখলেন যে, ঘটনাটি সত্য। ইহাতে তিনি নিজেকে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন এবং ক্রোধে ও ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে কালেক্টর সাহেবের সম্মুখস্থিত গোলকটি এক পদাঘাতে ভেঙ্গে ফেললেন। কালেক্টর সাহেব তার এই আচরণে হতভম্ব হলেন এবং এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, শম্ভুচন্দ্র ধীরভাবে বললেন— “ময়মনসিংহ পরগণার টাকা প্রথমে গৃহীত হয় নাই, তজ্জন্য এই কার্য করিয়াছি।” তার এই সাহসিকতায় সন্তুষ্ট হয়ে কালেক্টর সাহেব স্বীয় ত্রুটি স্বীকার করলেন এবং ভবিষ্যতে আর এমন কাজ হবেনা এইরূপ অঙ্গীকার করলেন।
গ) শম্ভুচন্দ্রের ধর্মানুরাগ ও পুণ্যকর্ম :
শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী ধর্মপ্রবণতার জন্যও প্রসিদ্ধ ছিলেন। সাধু সন্ন্যাসী, ফকিরদের জন্য তার ধনভাণ্ডার সর্বদাই উন্মুক্ত থাকত। জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি ধর্মকার্যের অনুষ্ঠানে অতিবাহিত করতেন। তিনি কখনই প্রাণী হিংসা করতেন না। তার জমিদারির মধ্যে যদি কেও প্রাণী হিংসা করত, তখনই তার উপযুক্ত দণ্ড বিধান করতেন। বিগ্রহের সেবাপূজার জন্য একটি জমিদারি ক্রয় করেন এবং উৎসর্গ করেন। জমিদারির কাজে তিনি বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। জমিদারিতে বন্দোবস্ত ও নূতন জমিদারি ক্রয় করে পৈতৃক সম্পত্তির বিশেষ উন্নতি করেছিলেন।
ঘ) শম্ভুচন্দ্র চৌধুরীর পরিবারের বিবরণ ঃ
গৌরীপুরের বোকাইনগর বাসাবাড়ির নয়া তরফের জমিদার শম্ভুচন্দ্র প্রথমত অলকমণি দেবীকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে কোন সন্তানাদি না হওয়ায় তার পর অমরনাথ রায়ের কন্যা মঙ্গলা গৌরীদেবীকে বিয়ে করেন। মঙ্গলা গৌরীদেবীর গর্ভেই ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরী, ঈশানচন্দ্র চৌধুরী ও হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী নামে তিন পুত্র জন্মে। জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশানচন্দ্র অবিবাহিত অবস্থায় পিতা মাতার হৃদয় শূন্য করে পরলোকগমন করেন। মধ্যম পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীকে পূর্বেই নবাব সিরাজের পুত্র ও আলেয়ার গর্ভজাত সন্তান এবং গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা জমিদার যুগল কিশোর রায়চৌধুরীর বিধুবা পুত্রবধূ ভাগীরথী দেবী দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন এবং জমিদারির নিয়ম অনুযায়ী দত্তক পুত্রের নাম ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর নাম পরিবর্তন করে আনন্দ কিশোর রায়চৌধুরী নাম রাখেন। কনিষ্ঠ পুত্র হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী পিতামাতার স্নেহ যত্নে পরিবর্ধিত ও পিতৃগুণে ভূষিত হয়ে রাজবংশোজ্জ্বল করেন।
ঙ) শম্ভুচন্দ্রের মৃত্যু ও উত্তরাধিকারঃ
শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী বাংলা ১২৬০ (ইংরেজি ১৮৫৪) সালে ভারতের বৃন্দাবন ধামে পরলোক গমন করেন। শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী মৃত্যুর পর তার কনিষ্ঠ পুত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হন। তিনি বাংলা ১২২৬ (ইংরেজি ১৮২০) সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার কাছে জমিদারি-কর্ম শিক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি বিজ্ঞান-চর্চায় বিশেষ আসক্ত ছিলেন। তিনি গৌরীপুর রাজবাড়ির তৃতীয় জমিদার আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরীর ছোট ভাই। রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী তার সৎকার্যের জন্য ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাণীর “ভারতেশ্বরী” উপাধি গ্রহণ উপলক্ষে তিনি “রাজা” উপাধি দ্বারা ভূষিত হন। ইংরেজ শাসনামলে ময়মনসিংহের জমিদারদের মধ্যে তিনিই প্রথম রাজা উপাধি পান। একই দিনে সুসঙ্গের রাজা পেয়েছিলেন মহারাজ উপাধি এবং মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী 'রায় বাহাদুর' উপাধি প্রাপ্ত হন। পরবর্তী সময়ে জমিদার সূর্যকান্ত 'রাজা' (১৮৮০) ও 'মহারাজা' (১৮৯৭) উপাধি প্রাপ্ত হন। রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার দত্তকপুত্র কুমার উপেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী পিতৃ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। তার নামে রয়েছে ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত কুমার উপেন্দ্র বিদ্যাপীঠ।
বিবিধ
পরিশেষে ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, পরবর্তীতে বোকাইনগর বাসাবাড়ি হতে আরো তিনটি রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া লক্ষ্মীগঞ্জ, ভবানীপুর, গোলকপুর, গোবিন্দপুর (গৌরীপুর), গোবিন্দগঞ্জ (মালঞ্চ, জামালপুর), শ্যামগঞ্জ (গৌরীপুর), শ্যামপুর (মেলান্দহ, জামালপুর ), শম্ভুগঞ্জ, ঈশ্বরগঞ্জ ইত্যাদি স্থানের নামকরণ বোকাইনগর বাসাবাড়ি জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণের বংশ তালিকা হতে সৃষ্টি। যেমন- লক্ষ্মীনারায়ণের স্ত্রী ভবানী দেবীর নামে ভবানীপুর এবং নাতনী গোলকমণি দেবীর নামে গোলকপুরের নামকরণ করা হয়েছে। লক্ষ্মীনারায়ণের নামে লক্ষ্মীগঞ্জ নামকরণ করা হয়েছে। ঈশ্বরগঞ্জের দক্ষিণে লক্ষ্মীগঞ্জ নামে বাস স্ট্যান্ড অবস্থিত।১৮৭৯-৮০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ৫৪টি ডাকঘর ছিল। ১৯০৭ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহে ৩টি প্রধান ডাকঘর, ৪৬টি সাব অফিস ও ১৪৭ ব্রাঞ্চ অফিস ছিল। যেমন- ২য় শ্রেণীর হেড অফিস শ্যামগঞ্জ, শম্ভুগঞ্জ, ডৌহাখলা; সাব পোস্ট অফিস- ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, রামগোপালপুর। ঈশ্বরগঞ্জের ইতিবৃত্ত ও অজানা কিছু ইতিহাস, পর্ব-১,২ ও ৩" প্রকাশিত হয়েছে।
তথ্য সূত্র:
১. ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার— শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার ও রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৩য় পুত্র)
২. ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ— শ্রী কেদারনাথ মজুমদার
৩. ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব— মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা
৪. ব্রিটিশ ভূবিদ মেজর জেমস রেনেলের অংকিত কয়েকটি মানচিত্র
৫. সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে— ভারত উপমহাদেশের অন্যতম কৃতী ইতিহাসবিদ ও প্রফেসর ড. অমলেন্দু দে
৬. নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস— আলী আহম্মদ খান আইয়োব
৭. উইকিপিডিয়ার উল্লেখিত শিরোনামগুলো থেকে (ক) ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা – উইকিপিডিয়া (খ) কলকাতা – উইকিপিডিয়া (৮) বাংলাপিডিয়া
(৯) ম্যাগাজিন: পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০, পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২১ ও ২০২২ এরং ২০২৩ (১০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন কর্তৃক প্রতিবেদন (এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ) (১১) ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন – দরজি আবদুল ওয়াহাব (১২) ময়মনসিংহের রাজপরিবার – আবদুর রশীদ। (13) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar and A General Map of the Roads in Bengal (14) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760- Richard M. Eaton (15) The History of British India- James Mill (16) The history of two forts in Gouripur, Mymensingh ( An article published in the New Nation). (17) David Rumsey Historical Map Collection. (18) New York Historical Society. (19) ১৯১৭ সালে F. A. Sachse এর সম্পাদিত Bengal District Gazetteers' Mymensingh (20) ১৯০৫ সালে প্রকাশিত MYMENSINGH DISTRICT GAZETTEER. STATISTICS, 1901-02.
লেখক, সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী