
ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারের গুরুত্ব
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্তে লেখা ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি সারা দুনিয়ায় পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ মাসকে ঘিরে বাঙালির অনেক আবেগ, অভিজ্ঞতা আর অর্জনের ইতিহাস আবর্তিত। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল। বাঙালির যত আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য তা সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়েই। বাঙালির সেই আত্মত্যাগ আজ বিশ্ব ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। এ আত্মত্যাগ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বিশ্ব সমাজকেও অনুপ্রাণিত করেছে।
সারা পৃথিবী আজ বাংলাদেশকে জানার পাশাপাশি বাংলা ভাষার ইতিহাসকে জানে। বাংলা ভাষার গৌরবের কথা জানে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারির কথা জানে। বাঙালির বীরত্বের কথা জানে। একুশে ফেব্রুয়ারির এই বীরত্ব জাতির জন্য এক মহান অর্জন। বর্তমান বিশ্বে মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে যে দেশটি এগিয়ে চলছে, তারাই গবেষণায় উন্নত দেশগুলকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ছয় বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর মাতৃভাষায় কথা বলা ও বোঝার দক্ষতা ১০০ শতাংশ অর্জিত হয়। মাতৃভাষা শিক্ষার বিষয়টি সব সময় প্রাকৃতিক ও স্বয়ংক্রিয়। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি জাতির মত মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের এমন ঘটনা বিরল।
বাংলা একটি সমৃদ্ধ, সৌন্দর্যমণ্ডিত, শ্রতিমধুর ও সহজ-সরল ভাষা। মনের আবেগ ও ভাব প্রকাশে বাংলাভাষায় শব্দের প্রাচুর্যতা নিয়ে গর্ব করা যায়। ভাষা যে দেশাত্মবোধে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো ভাষা আন্দোলন। ভাষা প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশ প্রেম। মূলত বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল বলেই সেই চৈতন্য বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহসী করেছে। ভাষা মনের ভাব এবং অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমের পাশাপাশি যোগাযোগেরও এক অনন্য মাধ্যম। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। যে কোনো ভাষাই তাদের সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তির কোষাগার। বর্তমানে বিশ্বের যে দেশ প্রযুক্তিতে যত বেশি এগিয়ে রয়েছে সে দেশ তত বেশি উন্নত।
অবশ্য এটা আমাদের জানা নেই যে অতীতের আরও অনেক ভাষাই হয়তো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে ভাষাদূষণ আমাদের দেশে এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষাদূষণ একটি সমৃদ্ধ সমাজের জন্য বিধ্বংসী হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে ভাষাদূষণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে । নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এসবই দুর্ভাগ্য এবং লজ্জাজনক। বাংলা ভাষার মতো পৃথিবীর কোথাও এমন মধুর ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, ভাষাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মায়ের ভাষার বিকৃতি রোধের সচেতনতার অভ্যাস পারিবারিক ভাবেই গড়ে তুলতে হবে। আমরা আমাদের সন্তানকে যদি বাংলা ভাষাকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে শেখাই তাহলে বড় হয়ে সে মাতৃভাষাকে দূষিত করবে না। এভাবেই বাংলা ভাষার মর্যাদাকে আমাদেরই আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে।
পৃথিবী জুড়েই আগ্রাসনের স্বীকার ভাষা। পুঁজিবাদীরা নিয়ন্ত্রণ করে ভাষাকেও। ভাষা তাই প্রাণ হারায়। এর ফলে ভাষা হারায় তার নিজস্ব গতি। সভ্যতার আক্রমণে বিস্মৃত প্রায় আমার মাতৃভাষাও। দুর্দশাগ্রস্ত আমাদের সংস্কৃতিও। প্রত্যেকের আঞ্চলিক ভাষা হচ্ছে তার মাতৃভাষা। বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির ভিন্নতা, জীবন যাপনের ভিন্নতাই আমাদের চিন্তা- চেতনা-সাহিত্য সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ করে। জীবন জীবিকা আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায় বিভিন্ন প্রান্তে। আমরা অভ্যস্থতায় গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকি। অভ্যস্ত হই পরিবেশের ভেতর। নিজেকে খোঁজার অবকাশ নেই। এমনি করেই ভাষাও মিলিয়ে যাচ্ছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের মাতৃভাষা।
আমাদের জীবনের পরতে পরতে আমাদের সংস্কৃতি এবং ভাষাকে আগলে রাখার চেতনা বুনে দিতে হবে। ইউনেস্কোর ভাষ্যমতে, একটি ভাষা তখনই হারিয়ে যায়, যখন সেই ভাষায় কথা বলা মানুষগুলো অন্য ভাষা গ্রহণ করে বা নিজের ভাষা ত্যাগ করে। এক্ষেত্রে বহিরাগত নানা শক্তির চাপ, হতে পারে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা শিক্ষার আধিপত্যবাদ। যার কারণে ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অবশ্য এক্ষেত্রে ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে প্রযুক্তি একটি ইতিবাচক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আমাদের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি লাভে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে বাংলা ভাষাকে প্রয়োজনানুসারে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তবে একথা সত্যি যে, তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে বাংলা ভাষার সমন্বিত প্রয়োগ খুবই সীমিত। গত এক দশকে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যতোটা কাজ হয়েছে সেসব হচ্ছে ই-গভর্ন্যান্স, শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলায় ডিজিটালাইজেশন, ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলায় ডিজিটাল রূপান্তর, মোবাইল সেবা ও মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার যদিও তুলনামূলক হারে বেড়েছে। কিন্তু এটা বাংলাকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত ভাষা প্রায় আট হাজার। এই সংখ্যার মধ্যে বহুল ব্যবহৃত ভাষার সংখ্যা মাত্র ৪ শতাংশ। সর্বাধিক কথিত বা ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। যদিও বাংলা সাহিত্যের ব্যাপ্তি বিস্তৃতি এবং সাহিত্যের মান নির্ধারণে সাহিত্য সমৃদ্ধ এই বাংলা ভাষা প্রথম সারিতে অবস্থান করার যোগ্যতা রাখে। ভাষা গবেষকগণ মনে করেন ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাভাষা ব্যবহারকারী লোকের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ। তবে এই সংখ্যাটা তখনই সম্ভব যখন এই ভাষাকে তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেটের সাথে সংযোগ করা সম্ভব হবে। শুধু আবেগ দিয়ে যেমন মানুষ বাঁচিয়ে রাখা যায় না, তেমনি ভাষার বেঁচে থাকাও নির্ভর করে বাস্তব উপযোগিতার ওপর।
অর্থাৎ ভাষা কখনও এমনি এমনি বাঁচে না, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। প্রকৃতির বিপন্ন প্রাণী বা উদ্ভিদকে টিকিয়ে রাখার জন্য যেমনি প্রাকৃতিক কৌশল মানুষকেই উদ্ভাবন করতে হয়, ভাষাকে টিকিয়ে রাখতেও প্রয়োজনীয় যুগোপযোগী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ছয় হাজারের অধিক ভাষার মধ্যে অন্তত ৪৩ শতাংশ ভাষা সংকটাপন্ন। বিশেষ করে জাতিগোষ্ঠীর ভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষা বিলুপ্তির পথে। ডিজিটাল বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে পৃথিবীর প্রায় ১০০ ভাষা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করা হয় মাত্র কয়েকশ বহুল ব্যবহৃত ভাষায়।
কাজেই ভাষা হারিয়ে যাওয়ার এ ধারা আরও বেশি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ভবিষ্যতে। ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে জাতিসংঘ সংস্থাগুলো মাতৃভাষা বা প্রধান ভাষার ওপর ভিত্তি করে বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে উৎসাহিত করছে। ইউনেস্কোর আরও তথ্য মতে পৃথিবীতে প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা গুরুত্ব দেবার মতোই। ভাষা একটা জনগোষ্ঠী বা জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বয়ে নিয়ে চলে। ভাষা বিলীন হয়ে যাওয়া মানে সেই জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংকটকে বুঝায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা যায় আমাদের দেশের নৃগোষ্ঠীদের ব্যবহৃত ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৪টির অবস্থা মুমূর্ষু।
কোনো কোনো ভাষায় কথা বলবার মতো লোকের সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জনে এসে ঠেকেছে। বর্তমানে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির অনেক শাখাকেই নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে, অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে চিন্তার পরিধিকে কয়েক গুণিতকে বড় করে দিয়েছে। তারই একটা ছোট্ট শাখা হলো 'ন্যাচালার ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং' বা ভাষা প্রক্রিয়াজাতকরণ। যেখানে মেশিনকে একটা ভাষা শেখানোর যাবতীয় পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করা হয়। আর মেশিন একটা ভাষাকে যতটা ভালো বুঝতে পারে, সেই ভাষাকে ততটাই আধুনিক বলা যায়। ফলশ্রুতিতে ওই ভাষা ব্যবহার করে মেশিনকে দিয়ে আমাদের অনেক কঠিন কাজগুলো খুব সহজেই করিয়ে নেয়া সম্ভব। উন্নত ভাষাগুলোর মতো বাংলাকে বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন করে সম্ভ্রমের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে হলে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার মতো আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাগুলোর প্রয়োগ প্রতিনিয়ত বাড়াতে হবে।
আধুনিক চিন্তাবিদদের মতে, ভাষাকে সম্মানের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে তা যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে সর্বজনীন করার কোনো বিকল্প নেই। ১৯৫২-তে যারা আত্মত্যাগের বিনিময়ে ভাষার যে স্বাধীনতা আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন ভাষার সেই স্বাধীনতাকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্ষা করাটা আমাদের প্রযুক্তিবিদদের এক প্রকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। একাবিংশ শতাব্দীতে একটি ভাষাকে সম্ভ্রমের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে ইন্টারনেটে ওই ভাষায় বিষয়বস্তুর সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় ভাষা প্রক্রিয়াজাতকরণের সরঞ্জাম এবং কৌশল প্রস্তুত এবং সেই সম্পর্কিত বিস্তর গবেষণা নিশ্চিতকরণ একটি অত্যাবশ্যকীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।