ডার্ক মোড
Saturday, 22 February 2025
ePaper   
Logo
শতভাগ বাংলায় হোক আদালতের রায় ও আইনের ভাষা

শতভাগ বাংলায় হোক আদালতের রায় ও আইনের ভাষা

মো. মোশারফ হোসাইন

দেশের নিম্ন আদালতের বিচারিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়লেও উচ্চ আদালতে এখনও উপেক্ষিত। উচ্চ আদালতে বেশিরভাগ রায় বা আদেশ এখনও ইংরেজীতে দেয়া হয়। তাছাড়া সকল আইন ইংরেজী ভাষায় করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।

অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদটি জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশ দিয়েছে বলে মনে করা হয়। সংবিধানের এই বিধান যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ, বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করা হয়। ওই আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠি-পত্র, আইন আদালতের ছওয়াল জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে’।

উপরন্তু আইনের ধারায় বলা হয়েছে, ৩(১) এ উল্লেখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন, তা বেআইনী ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। তারপরও হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের ফুল এবং দেওয়ানী ও ফৌজদারী কার্যবিধির দোহাই দিয়ে আদালত বাংলা ভাষা ব্যবহারকে ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত করে ধারাবাহিকভাবে ভিনদেশী ভাষা ইংরেজীতে আবেদন-নিবেদন, আপীল, ডিক্রী ও রায় দিয়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে আইন ও আদালত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে আস্থাহীনতার সুযোগ সৃষ্টি করছে।

এছাড়া, ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে কোন ফৌজদারী আদালতের বিচারিক রায় আদালতের ভাষায় অথবা অন্য কোন ভাষায়- যা আসামী অথবা তার আইনজীবী বুঝতে সক্ষম সে ভাষায় ঘোষণা অথবা উক্ত রায়ের বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করতে হবে’। সুপ্রীম কোর্টের রায়েও বাংলা ভাষা ব্যবহারের সুযোগ বিবৃত হয়েছে এই আইনে।

এসব বিবেচনায়, তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি বাংলায় রায় দেয়ার জন্য বিচারপতিদের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। এছাড়া প্রায় একযুগ আগে আইন কমিশন বাংলায় রায় দেয়ার জন্য একটি সুপারিশ প্রদান করে। কিন্তু দীর্ঘ একযুগ পরেও ওই সুপারিশ আলোর মুখ দেখছেনা। ফলে গ্রামের অনেকে এখনো যেকোন মামলার ইংরেজী ভাষার রায় বুঝেন না। তাই রায় বুঝতে তারা এলাকার শিক্ষিত লোকজনের কাছে বা আইনজীবীদের কাছে ছুটেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গ্রামের শতকরা ৯৮ ভাগ ছেলে-মেয়েরা আদালতের বেশিরভাগ রায় বা আদেশ ও আইন ইংরেজীতে হওয়ায় বুঝেননা। ফলে বিচার প্রার্থীসহ শিক্ষিত তরুণ সমাজ চরম বিপাকে পড়েন।

আদালতের সকল রায় বাংলায় হলে ভুক্তভোগীরা সহজেই জানতে ও বুঝতে পারতেন। নাগরিক হিসেবে অবশ্যই মামলার ফলাফল বা রায় জানা ও বুঝার অধিকার সবার রয়েছে। যেকোন রায় ও আইন বাংলাতে হলে জনগণ সহজে বুঝতে পারবেন। রায় বাংলায় দিলে জনগণ ঘরে বসে সহজেই অনলাইনের মাধ্যমে রায়টি দেখতে ও বুঝতে পারবেন। রায় বুঝতে কারো কাছে ছুটতে হবে না।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালত তাদের মাতৃভাষায় রায় প্রদান করে থাকে। জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন, চীন, নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের আদালত মাতৃভাষাতে রায় প্রদান করে। কিন্তু বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে প্রথা ও রীতিনীতির কথা বলে সব কাজকর্ম এখানো চলছে ইংরেজীতে। ৩০০ বছর আগেও যুক্তরাজ্যের আদালতের দাফতরিক ভাষা ছিল ফরাসী ও লাতিন। তখনো সেখানকার আদালতে ইংরেজিতে শুনানি হলেও সব নথিপত্র লেখা হতো লাতিন ভাষায়। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশের আইন ও উচ্চ আদালত গুলো। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতিরা রায় এবং বেশির ভাগ আদেশ বা নির্দেশ দিচ্ছেন ইংরেজীতে।

অথচ, বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, কিন্তু বাংলা ভাষার এই দেশের উচ্চ আদালতসহ অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। তাই আইন ও রায় গুলো বাংলায় দেওয়া উচিত। এদেশের বেশিরভাগ আইন ব্রিটিশ আমলের। যেমন, বিএলডি, ডিএলআর এগুলো এখোনা ইংরেজীতে রয়েছে। এসব বাংলায় হওয়া উচিত। সংসদে আইনগুলো বাংলা করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। বাংলায় আইন থাকলে বিচারপতিগণেরও রায় বাংলায় দিতে সুবিধা হবে।

সচরাচর যে সমস্ত আইন আছে সেগুলো বাংলায় করা এখন সময়ের দাবি। এ জাতি আজ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর উচ্চ আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কার্যকর না হওয়ার বেদনা থেকে মুক্ত হতে চায়। তাই যে বাংলা ভাষার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যপি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সেই মহান ভাষার স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে, দেশের সকল ক্ষেত্রে বিশেষ করে আইন, আবেদন-নিবেদন, আপীল, ডিক্রী ও রায় প্রদানে শতভাগ বাংলা ভাষা ব্যবহারের জোর দাবি জানাচ্ছি।

লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক নকলা, শেরপুর

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন