পার্লামেন্টের সদস্যপদ কি হারাতে চলেছেন রাহুল
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নামের পদবী ‘মোদি’ নিয়ে আপত্তিজনক মন্তব্যের জেরে বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীকে ২ বছর কারাবাসের সাজা দিয়েছেন গুজরাটের একটি আদালত। বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন রাহুল।
এই রায় অবশ্য এখনই কার্যকর হচ্ছে না। উচ্চ আদালতে আপিলের জন্য রাহুল গান্ধী ও তার আইনজীবীদের ৩০ দিন সময় দিয়েছেন আদালত।
তবে এই মুহূর্তে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের এই শীর্ষ নেতার সম্ভাব্য গ্রেপ্তার বা কারাবাসের সাজার ব্যাপারটি নিয়ে যতখানি আলোচনা হচ্ছে— তার চেয়েও বেশি ঘুরপাক কাছে একটি প্রশ্ন; সেটি হলো— রাহুল গান্ধী কি তার পার্লামেন্টের সদস্যপদ হারাতে চলেছেন?
২০১৯ সালে ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের আমেথি এবং সর্বদক্ষিণের রাজ্য কেরালার ওয়ানাড—দু’টি সংসদীয় আসন থেকে দাঁড়িয়েছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও তার স্ত্রী সাবেক কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সন্তান রাহুল গান্ধী।
ওই নির্বাচনে নিজের ঘরের আসন আমেথিতে হেরে গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ওয়ানাড আসনে জয়ী হয়ে পার্লামেন্টের টিকিট নিশ্চিত করেন তিনি। যে ‘অপরাধে’ বৃহস্পতিবার আদালত তাকে কারাদণ্ড দিয়েছেন— সেটি ঘটেছিল ওই নির্বাচনের সময়েই।
২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে কর্ণাটকের এক জনসভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় রাহুল বলেছিলেন, ‘সব চোরেরা কেন তাদের পদবিতে মোদী ব্যবহার করে? নীরব মোদি, ললিত মোদি, নরেন্দ্র মোদি…’
নীরব মোদী হচ্ছেন ভারতের পলাতক হীরা ব্যবসায়ী, আর ললিত মোদী হচ্ছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের সাবেক প্রধান যার উপর আজীবনের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড।
কিন্তু রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল পুর্ণেশ মোদী নামে দেশটির ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক আইনপ্রণেতার অভিযোগের ভিত্তিতে। গুজরাটের ওই বিধায়ক থানায় লিখিত অভিযোগে জানিয়েছিলেন, রাহুল গান্ধীর মন্তব্য সমগ্র মোদী সম্প্রদায়ের জন্য মানহানিকর। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলারই রায় বৃহস্পতিবার দিয়েছেন আদালত।
রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক ভবিষ্যত
সাজার রায় ঘোষণার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঘিরে। সুপ্রিম কোর্টের রায় ও জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, রাহুলের লোকসভার সংসদ সদস্য পদ খারিজ হবে কি না, সেই প্রশ্নে এই মুহূর্তে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গণে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে এক মামলার রায়ে জানিয়েছিলেন, কোনো মামলায় কোনো সংসদ সদস্য, বিধায়ক অথবা বিধান পরিষদের (বিধানসভার উচ্চকক্ষ) সদস্যের দুই বছর বা তার বেশি সময়ের সাজা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সদস্য পদ সঙ্গে সঙ্গে খারিজ হয়ে যাবে।
রাহুলের ক্ষেত্রে গুজরাটের ওই আদালতের বিচারক তার রায় এক মাস অকার্যকর রাখার কথা জানিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে উচ্চতর আদালত সিজেএমের রায় স্থগিত রাখলে তার সদস্য পদ বহাল থাকবে, না হলে রাহুল সদস্য পদ হারাবেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কেরালার ওয়েনাড লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন করানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তবে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গণে আরও একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো রাহুলকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেওয়া হলো কি না। এমনকি এ রায়ের মধ্যে দিয়ে দিয়ে সরকারি দল বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা হলো কি না, এমন কথাও উঠেছে। রাহুলের আইনজীবীরা এজলাসে বলেছেন, মানহানির মামলা করার কোনো এখতিয়ারই পূর্ণেশ মোদির নেই। কারণ, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত নন। রাহুলের আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। মামলা করতে হলে তারই করা উচিত ছিল।
তা ছাড়া ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০০ ধারা অনুযায়ী মানহানির মামলার সর্বোচ্চ রায় দুই বছর। রাহুলকে সর্বোচ্চ সাজাই দেওয়া হয়েছে।
অপরাধীদের হাত থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে লিলি টমাস বনাম কেন্দ্র মামলায় ওই যুগান্তকারী রায় দিয়েছিলেন। রায়ে বলা হয়েছিল, দুই বা তার বেশি বছরের সাজা হলে সদস্য পদ সঙ্গে সঙ্গে খারিজ তো হবেই, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাজার মেয়াদের সঙ্গে যুক্ত হবে আরও ছয়টি বছর। অর্থাৎ সাজাপ্রাপ্ত দুই বছর ও তার সঙ্গে ছয় বছর—সব মিলিয়ে আট বছর ওই ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এর আগে নিম্ন আদালতে দোষীরা উচ্চতর আদালতে আবেদন সাপেক্ষে সদস্য পদ বহাল রাখতে পারতেন।
সুপ্রিম কোর্টের সেই যুগান্তকারী রায়ের পর ১১ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সদস্য পদ খারিজ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিহারের আরজেডি নেতা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ এবং এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা।
সংসদের ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর অসম্মান ও বদনাম করার অভিযোগ এনে রাহুলের সদস্য পদ খারিজের দাবি ইতিমধ্যেই লোকসভার অধিকারভঙ্গ কমিটির বিবেচনাধীন। যুক্তরাজ্যে ‘দেশের অসম্মান করার’ জন্য সদস্য পদ খারিজ করতে কমিটি গড়ার প্রস্তাবও লোকসভার অধ্যক্ষের বিবেচনাধীন। এসবের সঙ্গে যুক্ত হলো আদালতের রায়।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে আজ বলেছেন, ‘যেভাবে রাহুলকে বারবার সমন পাঠানো হচ্ছিল, তাতে এমন কিছু আমরা আশঙ্কা করছিলাম। বিজেপির বোঝা উচিত, অন্যের জন্য কবর খুঁড়লে অনেক সময় নিজেদের সেখানে পড়তে হয়।’
মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং বলেছেন, ‘মোদি শব্দটি উচ্চারণ করলেই মানহানি ঘটতে পারে। ভারতের এখন অবস্থা এতটাই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক দিক থেকে মতানৈক্য সত্ত্বেও এই রায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির শীর্ষনেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এক টুইটবার্তায় তিনি বলেছেন, ‘অ–বিজেপি দল ও নেতাদের শেষ করে দেওয়ার এক চক্রান্ত শুরু হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য রয়েছে ঠিকই। তবু বলব, রাহুল গান্ধীকে এভাবে মানহানি মামলায় ফাঁসানো ঠিক হয়নি। প্রশ্ন তোলার অধিকার বিরোধী দল ও মানুষের রয়েছে। আদালতকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এই রায়ের সঙ্গে আমরা একমত নই।’