ডার্ক মোড
Wednesday, 25 December 2024
ePaper   
Logo
নানামুখী সংস্কার ও উদ্যোগে আশার আলো দেখাচ্ছেন ড. ইউনূস

নানামুখী সংস্কার ও উদ্যোগে আশার আলো দেখাচ্ছেন ড. ইউনূস

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। এ সরকার এমন একটা সময়ে ক্ষমতায় এসেছে যখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতিও। ভেঙে পড়া সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও অর্থনীতিকে চাঙা করতে দিনরাত পরিশ্রম করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।

দায়িত্বগ্রহণের দুই মাস শেষ হয়েছে এই সরকারের। এর মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে তারা। জাতিসংঘ অধিবেশনে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জো বাইডেনসহ বেশ কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে আশার আলো দেখাচ্ছেন তিনি।

অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের এই দুই মাসে সারা দেশে কমপক্ষে ৪৯ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের মতো ঘটনাও সামাল দিতে হয়েছে সরকারকে।
এসব সামলে নিয়েই বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার করছে নতুন সরকার।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। অনেককে আবার গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। দলীয় নেতারা এবং সরকারঘনিষ্ঠ উচ্চ পর্যায়ের আমলারাও গা ঢাকা দেন।

হাসিনা সরকারের পতনের দিন গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালান বিক্ষুব্ধ জনতা। তার আগে মাসব্যাপী চলা আন্দোলনে কর্তৃত্ব পরায়ণ হাসিনা সরকারের নৃশংস দমন-পীড়নে প্রাণ হারায় শিশু কিশোর শিক্ষার্থী নারীসহ হাজারো মুক্তিকামী মানুষ। বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জনতার এ বিজয়কে দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেন আন্দোলনকারীরা।

স্বৈরাচারী সরকার পতনের তিন দিন পর গত ৮ আগস্ট শপথ নেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ উপদেষ্টা। পরদিন ৯ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টাদের দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ১১ আগস্ট শপথ নেন উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ও বিধান রঞ্জন রায়। আর ১৩ আগস্ট শপথ নেন আরেক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। ১৬ আগস্ট বিকেলে আরও চার উপদেষ্টা শপথ নেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাদের শপথ পাঠ করান। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ২১ জন।

দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে ইউনূস সরকার। তার মধ্যে রয়েছে– জুলাই ও আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ জানানো; শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির উদ্যোগ, সেই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির উদ্যোগ; ব্যাংকগুলোকে বড় বড় ঋণখেলাপি ও লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে মুক্ত করে পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠন; দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড়শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি ও ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু; ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল; দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা; গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে এমন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত।

এ ছাড়া বলপূর্বক গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর ও বিগত সরকারের আমলে সংগঠিত গুমের ঘটনা তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন; দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন; আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন; স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন; সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ প্রদান এবং প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানানো; দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল চালু, শুক্রবারও মেট্রোরেল চালু রাখার সিদ্ধান্ত; মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী স্বর্ণা দাস নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানো এবং দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। সেখানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। দলগুলোর প্রতিনিধিরা সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন। এ ছাড়া সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৪৯ জনের। তবে মাত্র তিনটি ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এদিকে, খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামে এক শিক্ষকে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তারপরও সংঘর্ষ ও বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশন একসঙ্গে গঠন করা হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার (৭ অক্টোবর) সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে।

জাতিসংঘ অধিবেশন ও ড. ইউনূসের তৎপরতা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাত্র দেড় মাসের মাথায় জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। মাত্র চার দিনের সফরে সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের বৈঠক হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ ১২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আইএমএফের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকসহ ড. ইউনূস অংশ নিয়েছেন ৪০টি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অধ্যাপক ড. ইউনূস এই সফরে বিভিন্ন ইস্যুতে যেসব মিটিং করেছেন তা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া সংস্কারমূলক কাজের জন্য বিশ্বব্যাংক ইউনূসের সরকারকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয় ড. ইউনূসের। বৈঠকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে উন্নয়ন হলেও বাংলাদেশে দুর্নীতি ও মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে তার সুফল সাধারণ মানুষ পায়নি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত সংস্কারে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে বলে মনে করেন তারা।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন