ঈশ্বরগঞ্জের ইতিবৃত্ত ও অজানা কিছু ইতিহাস পর্ব-১
মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার
ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণের বয়স প্রায় পৌনে দুই শত বছর। এই নামের উত্পত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কবে, কখন, কিভাবে ঈশ্বরগঞ্জ নামকরণ হয়েছিল তা বলা দুরূহ ব্যাপার। এ নামকরণ সম্পর্কে তেমন কোন দালিলিক প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। তবে ‘ঈশ্বরগঞ্জ' নামটি কীভাবে এলো, তা নিয়ে এবং পর্যাক্রমে ইতিহাসের কিছু তথা উপাদান সংগ্রহ করে ময়মনসিংহের গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন (ACECC Association ), ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি এন্ড লাইব্রেরি এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে আসছে। সরেজমিন ও গবেষণার মাধ্যমে ঈশ্বরগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধানী তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
ঈশ্বরগঞ্জ বাজারের গোড়াপত্তন
ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণ নিয়ে দুই-একটি কাহিনী পাওয়া যায়। ঈশ্বরগঞ্জ রাখার পেছনে রয়েছে গৌরীপুরের বোকাইনগর বাসাবাড়ি জমিদারদের ইতিহাস । কীভাবে একটি নৌবন্দর বা নতুন গঞ্জের নাম ঈশ্বরগঞ্জ রাখা হল - এ বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করেন বিভিন্ন ইতিহাসবিদরা। অনেকে মনে করেন ঈশ্বরগঞ্জের পূর্ব নাম ছিল পিতলগঞ্জ। সরেজমিনে দেখা যায়, কাঁচামাটিয়া নদীর ধারে পুম্বাইল এফ. ইউ. ফাজিল মাদ্রাসাসহ কিছু এলাকা নিয়ে পিতলগঞ্জ। এই মাদ্রাসার অর্থনীতি বিষয়ের প্রভাষক মো. মাহমুদুল হাসান শামীম বলেন, পিতলগঞ্জ তামা, কাঁসা ও পিতলের জিনিসের জন্য একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক এলাকা ও নদীবন্দর ছিল। পুম্বাইল (পিতলগঞ্জ) হতে এক কিলোমিটার পূর্বে দত্তপাড়া চরনিখলা মৌজায় ঈশ্বরগঞ্জ বাজারের গোড়াপত্তন হয়। তাছাড়া বর্তমানে এই নামে দক্ষিণে অর্থাৎ হোসেনপুর উপজেলার ২নং সিদলা ইউনিয়নে পিতলগঞ্জ বাজার রয়েছে। কথিত আছে যে, নদী বিধৌত এ অঞ্চলে মাঝি ও জেলে সম্প্রদায়ের কিছু বিচ্ছিন্ন উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। তখন থেকেই ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণের কিংবদন্তি শুনে আসছে সাধারণ মানুষ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলের শাসন-শোষণে একজন ইংরেজ হত্যাকারী ও খেয়াঘাটের মাঝির নামে ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল এই নিয়ে অনেক ঐতিহাসিকদের মতবিরোধ রয়েছে। মাঝির নাম ছিল ঈশ্বরপাটনী। তখনকার সময়ে ইংরেজ ও জমিদারদের অনুমতি ও সাহায্য ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান করা অসম্ভব। কিংবদন্তির উপর নির্ভর করে বর্তমানে ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণ হয়েেছ। ঈশ্বরগঞ্জ নামকরণ নিয়ে স্থানীয় লোকদের মধ্যে অনেকের যুক্তি খন্ডন করা করা হয়েছে যে, তারা সঠিক ইতিহাস জানে না। কিন্তু প্রকৃক পক্ষে এক জমিদারের ছেলের নামে ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল।
ঈশ্বরগঞ্জ নামকরণের অজানা কিছু ইতিহাস
মোমেনসিং পরগণার মধ্যে ঈশ্বরগঞ্জের গোড়াপত্তন ও নামকরণ করা হয়। মোমেনসিং পরগণার জায়গিরদার ছিলেন বোকাইনগরের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী। বীরযোদ্ধা খাজা উসমান খাঁর আমলে মোমেনসিং পরগণাসহ বেশ কয়েকটি পরগণার রাজধানী ছিল কেল্লা বোকাইনগরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলে বোকাইনগরের প্রাচীন শহরটি কালেক্টরেটের (সরকারি রাজস্বের) অধীনে চলে আসে। তৎকালীন সময়ে ময়মনসিংহ জেলার প্রধান ও প্রতিষ্ঠাকালীন কালেক্টর ছিলেন ডব্লিউ রটন ( W Wroughton, Collector of Momensing) সাহেব। গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুরের তৎকালীন জমিদার শ্রীশৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর লেখা ‘কেল্লা বোকাইনগর (সচিত্র) ’ ফিচার বাংলা ১৩২০ সালে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত 'ভারতী' নামে মাসিক পত্রিকায় বোকাইনগরের শহর ও কেল্লার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ফিচারটি থেকে প্রাচীন নগর বা শহর সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো - "এখনও খলিফাপটি বেনেপটি, তামাকপটি, প্রভৃতি নাম পূর্ব্বগৌরবের পরিচয় দিতেছে। কয়েকঘর তন্তুবায় অদ্যাপি এখানে বস্ত্রবয়ন দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছে ! বর্তমানে পূর্ব শিল্পগৌরব ও নগরবৈভব পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছে। কোন্ সময় হইতে বোকাই নগরের অবনতি আরম্ভ হয় তাহা জানা যায় না। বোকাইনগর জমিদারের অধীন নহে, ইহা কালেক্টরীর খাস্ মহালভুক্ত। কিছু দিন পূর্ব্বে যে স্থান ভীষণ হিংস্র জন্তুর বিচরণ ক্ষেত্র ছিল" এই উদ্ধৃতি প্রমাণ করে বোকাইনগরকে বলা হয় ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুর উপজেলার প্রাচীন শহর। উল্লেখ্য যে, বোকাইনগর দুই উপজেলার মাঝে অবস্থান। ঈশ্বরগঞ্জ শহর হতে মাত্র ৫ কিলো দূরে কেল্লা বোকাইনগর অবস্থান। মোমেনসিং পরগণার জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষ্মীনারায়ণ এই চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। গৌরীপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন কৃষ্ণগোপালের দত্তকপুত্র যুগলকিশোর রায় চৌধুরী, রামগোপালপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন প্রয়াত কৃষ্ণকিশোর রায় চৌধুরীর দুই বিধবা স্ত্রী রত্নমালা ও নারায়নী দেবী, কালীপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী এবং বোকাইনগর বাসাবাড়ি এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কনিষ্ঠ ছেলে লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী। ১৭৭০ সালে যুগলকিশোর রায় চৌধুরী (হিন্দু জমিদার পরিবারের পরিচয়ে বেড়ে ওঠা নবাব সিরাজের অপর স্ত্রী আলেয়ার গর্ভে জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তান) গৌরীপুর শহর প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, পরবর্তীতে বোকাইনগর বাসাবাড়ি হতে আরো তিনটি রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া লক্ষ্মীগঞ্জ, ভবানীপুর, গোলকপুর, গোবিন্দপুর, গোবিন্দগঞ্জ (মালঞ্চ), শ্যামগঞ্জ, শ্যামপুর (মেলান্দহ), শম্ভুগঞ্জ, ঈশ্বরগঞ্জ ইত্যাদি স্থানের নামকরণ লক্ষ্মীনারায়ণের বংশ তালিকা হতে সৃষ্টি। যেমন- লক্ষ্মীনারায়ণের স্ত্রী ভবানী দেবীর নামে ভবানীপুর এবং নাতনী গোলকমণির নামে গোলকপুরের নামকরণ করা হয়েছে। লক্ষ্মীনারায়ণের নামে লক্ষ্মীগঞ্জ নামকরণ করা হয়েছে। ঈশ্বরগঞ্জের দক্ষিণে লক্ষ্মীগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড অবস্থিত।
ঈশ্বরগঞ্জ বাজারের প্রতিষ্ঠাতা বোকাইনগর বাসাবাড়ির জমিদার শম্ভু চন্দ্ৰ চৌধুরী
লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র তিন ছেলে পিতার সম্পত্তির অধিকারী হয়ে কিছুদিন একত্রে ছিলেন। পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়। শ্যামচন্দ্র চৌধুরী পৃথকভাবে বাসাবাড়ির কাছেই বাসস্থান তৈরি করে বসবাস শুরু করেন।শ্যামচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার একমাত্র উপযুক্ত বংশধর শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। তিনি অতি ধৈর্যশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। তার অমায়িক ব্যবহারে, ন্যায় বিচারে, সুশাসনে প্রজাদের সুখশান্তির সহিত জমিদারিরও বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। তিনি ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে তার নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। বাজারের নাম শম্ভুগঞ্জ। বর্তমানে এটি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত একটি শহরাঞ্চল। জমিদার শ্রীশৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে শম্ভুগঞ্জ নামক প্রসিদ্ধ বাজারের সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। শম্ভুগঞ্জ বাজার সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো –" তিনি নিজ নামে একটি বৃহৎ বাজার স্থাপনা করিয়া সাধারণের প্রভূত উপকার সাধন করিয়াছেন। অদ্যাপি শম্ভুগঞ্জ নামক প্রসিদ্ধ বাজার তাহার কীর্তির পরিচয় দিতেছে।"
শম্ভুচন্দ্র প্রথমত: অলকমণি দেবীকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে অমরনাথ রায়ের কন্যা মঙ্গলা গৌরীদেবীকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে ঈশানচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র ও হরিশ্চন্দ্র নামে তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশানচন্দ্র অবিবাহিত অবস্থায় পিতা মাতার হৃদয় শূন্য করে পরলোক গমন করেন। মধ্যম পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর নামে বোকাইনগর হতে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে তিনি একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। বাজারের নাম ঈশ্বরগঞ্জ। তখনকার সময়ে ঈশ্বরগঞ্জ ও লক্ষ্মীগঞ্জ শম্ভুগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর শিশুকালে গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রয়াত হরকিশোর রায় চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী ভাগীরথী দেবী দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন এবং তার নতুন নাম রাখেন গৌরীপুর রাজবাড়ির তৃতীয় জমিদার হিসেবে আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরী। কনিষ্ঠ পুত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী পিতামাতার স্নেহ যত্নে লালিত হয়ে ও পিতৃগুণে ভূষিত হয়ে জমিদারির বংশোজ্জ্বল করেন। শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী বাংলা ১২৬০ (১৮৫৪ খ্রিষ্ট্রাব্দ) সালে বৃন্দাবন ধামে পরলোক গমন করেন। গৌরীপুর রাজবাড়ির জমিদার আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরী হরফে ঈশ্বর চন্দ্র চৌধুরীর জীবন অকালে শেষ হওয়ায় তার শিশুপুত্র রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীই সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। রাজেন্দ্র কিশোর বাংলা ১২৫৬ সনের ৫ ভাদ্র(২০ আগস্ট, ১৮৪৯) জন্মগ্রহণ করেন।
লেখক, সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী