
মুরাদনগরে ‘ধর্ষণ’: ভাইকে ‘শায়েস্তা করতে মবের পরিকল্পনা’ শাহ পরাণের, তার ‘নির্দেশেই’ নির্যাতন ও ভিডিও
কুমিল্লার মুরাদনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নারীকে ‘ধর্ষণের’ ঘটনার মূল আসামি ফজর আলীকে 'শায়েস্তা করতে' তার ছোটভাই শাহ পরাণই সেদিন ‘মব তৈরির পরিকল্পনা’ সাজিয়েছিলেন বলে তথ্য দিয়েছে র্যাব।
শাহ পরাণকে গ্রেপ্তারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব বলছে, তার পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সঙ্গীরা ঘরে প্রবেশ করে ওই নারীকে শারীরিক নির্যাতন করে। সেই ঘটনার ভিডিও করে পরে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।
মুরাদনগরের বুড়িচং এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার বিকালে শাহ পরাণকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ব্যক্তিই মুরাদনগরে ‘মব সৃষ্টির কারিগর, প্রধান উসকানিদাতা এবং পরিকল্পনাকারী' বলে র্যাবের ভাষ্য।
শুক্রবার ঢাকার কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন।
মুরাদনগরে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ‘ধর্ষণ’ এবং ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ওই ঘটনা নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে সারা দেশে তীব্র সমালোচনা চলছে। ফজরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী নারী। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফজর আলী, তার ভাই শাহ পরাণসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, "মবটা যারা করেছে, যারা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ভিডিওটা ভাইরাল করেছে তাদের কয়েকজন ধরা পড়লেও উসকানিদাতা শাহ পরাণ ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।"
তিনি বলেন, শাহ পরাণ ও ফজর আলী দুই ভাই ভিকটিমকে দীর্ঘদিন ধরে উত্যক্ত করে আসছিলেন। পরে এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে 'দ্বন্দ্ব' সৃষ্টি হয়।
ওই দ্বন্দ্ব মেটাতে মাস দুয়েক আগে দুই ভাইকে নিয়ে গ্রামে একটি 'সালিশ হয়' জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, "সালিশে শাহ পরাণকে হেনস্তা ও মারধর করে ফজর আলী। সে কারণে শাহ পরাণ তার বড় ভাইয়ের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করে।"
ঘটনার ১৫ দিন আগে ভিকটিম বাবার বাড়ি আসেন। ফজর আলী ভিকটিমের মাকে সুদের বিনিময়ে ৫০ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন। ধারের টাকা আদায় করার জন্য মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যেতেন ফজর আলী। ঘটনার দিনও টাকা আদায়ের নামে ফজর আলী ভিকটিমের বাসায় যান।
র্যাব কর্মকর্তা সাজ্জাদ বলেন, "বিষয়টি শাহ পরাণ জানতে পেরে তার লোকজনকে বলে এই টাইমে যাবে, তোমরা যদি ধরতে চাও ধরতে পার।
"পরিকল্পনা অনুযায়ী রাতে ফজর আলী ভিকটিমের ঘরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পর শাহ পরাণের লোকজন সেখানে প্রবেশ করে ভিকটিমকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়।
মূলত দুই ভাইয়ের 'দ্বন্দ্বের জেরে' ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে মন্তব্য করে র্যাব কর্মকর্তা সাজ্জাদ বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে তারা ভিকটিমকে উত্যক্ত করছিল। দুই ভাই একজনের পেছনে ছুটছে, সেখান থেকে দ্বন্দ্ব। সেখান থেকে একটা গ্রাম্য সালিশ। সেই সালিশে ফজর আলী কর্তৃক হেনস্থার শিকার হয় শাহ পরাণ। সেটারই প্রতিফলন সেদিনের 'মবের' ঘটনা।
"ফজর আলী ৫০ হাজার টাকা ধার দিয়েছে, মাঝে মাঝে টাকা আদায় করার জন্য ভিকটিমের বাসায় যেত। সে অনুযায়ী মবটা প্ল্যান করে শাহ পরাণ। সে একটা মেসেজ দেয় ইমোর মাধ্যমে, মেসেজটা আমাদের কাছে আছে।"
ওই মেসেজে বলা হয়েছিল 'ওইদিন যাবে তোমরা কি তাকে এরকম করতে চাও কি-না' বলেন র্যাব কর্মকর্তা সাজ্জাদ।
যাকে মেসেজটা দেওয়া হয়েছে, তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি, এ কারণে তার নাম-পরিচয় র্যাব প্রকাশ করেনি।
শাহ পরাণের রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাইলে র্যাব কর্মকর্তা সাজ্জাদ বলেন, "অপরাধ অপরাধই, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচ্য বিষয় না। সে সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক। তবে তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাইনি।"
ভিডিওটা কে করেছিল এবং কে ছড়িয়ে দিয়েছিল জানতে চাইলে সাজ্জাদ বলেন, "আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এখনও কয়েকজন গ্রেপ্তারের বাকি আছে।"
গত রোববার কুমিল্লা জেলা পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৬ জুন রাতে মুরাদনগরে একটি গ্রামে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ফজর আলী নামে এক ব্যক্তি আটক ও পিটুনির শিকার হয়। পরে ফজর সেখান থেকে পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলে কিছু ব্যক্তি ভুক্তভোগীর ভিডিও ধারণ করে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। পরে মুরাদনগর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ‘আইনানুগ ব্যবস্থা’ গ্রহণ করে।
ওই নারী পরে সাংবাদিকদের বলেন, টাকা ধার নেওয়া নিয়ে ফজর আলীর সঙ্গে তাদের পরিবারের পরিচয় হয়। এ সূত্র ধরেই ফজর আলী বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে ‘ধর্ষণ করে’।
ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ফজর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে। তিনি এখন পুলিশ পাহারায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় গ্রেপ্তার চারজন তিন দিনের রিমান্ডে আছেন। তারা হলেন- সুমন, রমজান, মো. আরিফ ও মো. অনিক।