৩ বছরে দ্বিগুণ হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী,বাড়ছে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি
নিজস্ব প্রতিবেদক
বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসবাদের মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রতি তিন বছরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে, যার ফলে অনলাইন র্যাডিকালাইজেশনের ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি জরিপে উঠে এসেছে, ৮২ শতাংশ তরুণ অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হচ্ছে, যা মোকাবিলা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বৃহস্পতিবার (১৬ মে) দুপুরে ‘জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমনে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগরিকের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালায় এতথ্য তুলে ধরা হয়। অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) উদ্যোগে রাজধানীর মিরপুরেপুলিশ স্টাফ কলেজের মাল্টিপারপাস হলে দিনব্যাপী এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান।
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে মনিরুজ্জামান বলেন, সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেলেও বর্তমানে সন্ত্রাসের ভয়াবহতা বিস্তার লাভ করছে এবং বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র এর শিকার হচ্ছে। উন্নত-অনুন্নত, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, মুসলিম-অমুসলিমসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও সন্ত্রাসের কবল থেকে রক্ষা পায়নি।
তিনি বলেন, কালের পরিক্রমায় সন্ত্রাসের ধরন, প্রকৃতি ও মাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। তথ্য প্রযুক্তির বিস্তৃতি, অর্থ সংগ্রহের বিভিন্ন মাধ্যম, অস্ত্র-বিস্ফোরক ও প্রশিক্ষণ উপকরণ প্রাপ্তির সহজলভ্যতাসহ বহুবিধ কারণে সন্ত্রাসবাদ আক্ষরিক অর্থেই একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালিত হয় চরমপন্থি রাজনীতির নামে ও স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলমন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ উদার মুসলিম গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চক্রান্তের ফলে এখানেও বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসবাদের অশুভ ছায়ার বিস্তার ঘটেছে।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় দেখা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। আশির দশকে (১৯৭৯-১৯৮৯) আফগান যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি উগ্রমতাদর্শী মুজাহিদীন গোষ্ঠী বাংলাদেশে ফিরে এসে তালেবানি স্টাইলে বাংলাদেশকে পরিচালিত করার চেষ্টা করে।
পরে তালেবান কর্তৃক কাবুলে সরকার গঠন করলে তারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯২ সালে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হরকাতুল জিহাদ (হুজি-বি) গঠন করে। বাংলাদেশে সাংগঠনিকভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদের সূচনা হয় ১৯৭৯-১৯৯২ সালে, এসময়কে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রথম পর্যায় ধরা হয়। পরে সময়ের পরিক্রমায় কখনো আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অনুকূল পরিবেশে ও প্রশ্রয়ে একাধিক উগ্রবাদী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে কিতাল ফি সাব্বিল্লাহ যা ১৯৯৮ সালে জেএমবি নামধারণ করে; তৃতীয় পর্যায়ে হিযবুত তাহরীর এর গঠন ও কার্যক্রম শুরু হয় ২০০০ সালে। সর্বশেষ পর্যায়ে আনসার আল ইসলাম এর কার্যক্রম শুরু ২০১৪ সাল থেকে। এরপর নব্য জেএমবি ও বর্তমানে আলকায়েদার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়া এর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ষাটের দশকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গড়ে ওঠা চরমপন্থি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যকলাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশ সফলতা অর্জন করেছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশ সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের সহায়ক পরিবেশকে মোকাবিলা, প্রতিরোধ, বিশেষ অভিযান পরিচালনাসহ সন্ত্রাসীদেরকে আইনের আওতায় আনা, সঠিক তদন্ত, মনিটরিং ও পুনর্বাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনবলের সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি উদ্যোগ দ্বারা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে উদ্ভূত সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান, সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডসমূহ, সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন ও বৈশ্বিক সন্ত্রাস বিরোধী কৌশলগুলো অনুসরণ করে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতির অনুসরণে বাংলাদেশ পুলিশসহ অন্যান্য সহযোগী সংস্থা নিরলস কাজ করছে।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ দমন ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান সিআইডি, সিটিটিসি, এটিইউ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও র্যাব একযোগে কাজ করে প্রতিরোধমূলক ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার প্রয়োগ, সফল অভিযান, সন্ত্রাসী সংগঠন নিষিদ্ধকরণ (৯টি), ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম অনুসরণ, নিবিড় গোয়েন্দা কার্যক্রম, কমিউনিটি এনগেজমেন্ট, ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন, রিহ্যাবিলিটেশন ইত্যাদির মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে জনগণের আস্থা এবং বহির্বিশ্বের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার ইনস্টিটিউট ফর ইকোনোমিক্স অ্যান্ডপিস (আইইপি) এর পর্যালোচনায় ২৩টি সূচকের ভিত্তিতে বিচার্য সন্ত্রাসবাদ সূচকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থানের ধারাবাহিক উন্নতি পরিলক্ষিত হয় (২০২৩ সালে অবস্থান ৪৩তম, ২০২২ সালে ৪০তম যা ২০১৬ সালে ২২তম ছিল)। বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে ৩৭ ধাপ, আমেরিকা থেকে ১৩ ধাপ, শ্রীলঙ্কা থেকে ১৪ ধাপ, ইন্ডিয়া থেকে ৩০ ধাপ, মিয়ানমার থেকে ৩৪ ধাপ, আফগানিস্তান থেকে ৪২ ধাপ, নেপাল থেকে ৭ ধাপ নিচে অবস্থান করছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উপনীত হওয়ার সম্মান অর্জন করেছে।
বর্তমানে জঙ্গিবাদের চ্যালেঞ্জ বহুমুখী, যার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন- প্রতি তিন বছরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে, যার ফলে অনলাইন র্যাডিকালাইজেশনের ঝুঁকি বাড়ছে, একটি জরিপে দেখা গেছে ৮২ তরুণ অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হচ্ছে যা মোকাবিলা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, প্রায় ৬৬.৯৪ মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ নিরীক্ষণ করা অসম্ভব, তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ হলেও তাদের সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতার অভাব, কারাগার ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হওয়ায় সন্ত্রাসীদের সংস্পর্শে এসে উগ্রবাদী মতাদর্শে দীক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকটভাবে বিদ্যমান, বিদেশ ফেরত বা দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে যুক্ত হওয়া, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও ক্ষোভকে পুঁজি করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা যেকোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ক্রমবর্ধিষ্ণু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদের দিকে পরিচালিত করতে পারে, পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক ও বাহ্যিক প্রভাবে নারীদের ও শিশু সন্তানসহ পুরো পরিবারের সন্ত্রাসবাদে জড়িত হওয়ার ঝুঁকি, লোন উলফ্ আক্রমণের ঝুঁকি ও অপরাধ-সন্ত্রাসবাদ ও রাজনীতি-সন্ত্রাসবাদ এর সংযোগ এবং ধনী পরিবার ও শিক্ষিত তরুণ/যুবকদের সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি।
অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি এস এম রুহুল আমিন বলেন, এটিইউ এর ডিআইজি (প্রশাসন) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর অতিরিক্ত আইজিপি ড. মল্লিক ফখরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান।
রুহুল আমিন বলেন, ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ১১ বছরে জঙ্গিরা একটা আক্রমণও করেনি যেটা ইসরায়েল বা আমেরিকার স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়। সব আক্রমণ মুসলিম রাষ্ট্রে বা মুসলমানদের ওপরে। মুসলমানদের হত্যা করে তারা কোন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠী মুসলমানদের ভালো চায় না দাবি করে এটিইউ প্রধান বলেন, তারা কোনো গোষ্ঠী বা কার স্বার্থে কাজ করে সেটা স্পষ্ট। জিহাদ নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা ভুল। জিহাদের নামে উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদকে ইসলাম সমর্থন করে না। জিহাদের নামে মুসলমানদের যারা হত্যা করছে তাদের কর্মকাণ্ড ইসলাম বিরোধী এটা স্পষ্ট, কোরআন হাদিস ও আলেমদের ফতোয়ায় সেটা স্পষ্ট।
স্বাগত বক্তব্যে পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর অতিরিক্ত আইজিপি ড. মল্লিক ফখরুল ইসলাম বলেন, যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন জগতে ব্যবহারকারী বাড়ছে তাকে জঙ্গিবাদের প্রচার বা প্রসার কিংবা প্রভাবিত করার সুযোগ বেড়েছে। সে দিকটায় এখন গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।