
শিক্ষা বাজেটে আরো হতাশা
স্টাফ রিপোর্টার
নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে কিছুটা কমেছে।
বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দকে ‘হতাশার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষা বাজেটে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি’ বলে মনে করছেন তারা।
সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার যে বাজেট উত্থাপন করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৭ শতাংশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শিক্ষা খাতে মূল বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ৯৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
খরচ করা ওই টাকার পরিমাণ ছিল সংশোধিত বাজেটের ১৩.৩২ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৮ শতাংশ।
অথচ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়।
এই বাজেট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বাজেটে কি আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন পেলাম? অবশ্যই না। জুলাই অভ্যুত্থানের পর শিক্ষাখাত গুরুত্ব পাবে বলে আশা ছিল, কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন দেখলাম না।
“শিক্ষা মানের দিকে যখন সবাই জোর দিচ্ছে, তখন জিডিপির অনুপাতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমা হতাশার। কারণ যে কোনো উদ্যোগের মেরুদণ্ড হল ফাইন্যান্স। বরাদ্দ না থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ আমরা কিভাবে আশা করব?”
২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য যে বাজেট অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ উপস্থাপন করেছেন তাতে শিক্ষার দুটি মন্ত্রণালয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের থেকে টাকার অংকে ৯৩৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে মোট ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল মোট ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা কম বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। গত অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা।
প্রাথমিক শিক্ষায় প্রস্তাবিত বরাদ্দ টাকা হিসাবে কিছুটা কমলেও গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।
বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে ৮৯৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ বিভাগের জন্য ১২ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা ছিল।
আর নতুন অর্থবছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য ১২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ে ৯৩৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব ‘আশানরূপ নয়’ বলে মন্তব্য করছেন সিপিডির রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, “শিক্ষায় টাকার অংকে যতটুকু বরাদ্দ বেড়েছে তা আশানরূপ নয়, তবে প্রাথমিক শিক্ষায় বারাদ্দ অনেকটা কমে যাওয়া হতাশার। আমাদের আশা ছিল শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।
“সরকারের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকায় শিক্ষায় আশানরূপ বরাদ্দ আসেনি। রাজস্ব আদায়ের হার আশানরূপ থাকলে শিক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ খাত আরও অগ্রাধিকার পেত বলে আমি মনে করছি।”
উচ্চ শিক্ষার মানে নজর দেওয়ার পরামর্শ
উচ্চশিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, “আমাদের যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোর মান কোন দিকে যাচ্ছে সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটা
পিছিয়ে। বিশ্ব র্যাংকিংগুলোতে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।”
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে এ শিক্ষাবিদ বলেন, “বেসরকারি যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে, সেগুলোর প্রত্যেকটিতে কি শিক্ষার মান ঠিক আছে? এমন বহু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলোতে অধ্যাপক নেই। এমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে।
“যে টাকায় একজন অধ্যাপকের বেতনভাতা হয়, সে টাকায় হয়ত তিনজন প্রভাষককে নিয়োগ দেওয়া যায়। সেখানেও অর্থনৈতিক চিন্তা। আমার মনে হয়, এ জায়গাগুলোতে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। সরকারের উচিত উচ্চশিক্ষার মানে নজর দেওয়া।”
স্কুল ফিডিংয়ে ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা
বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আগামী অর্থবছরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচির জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি।
“প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান। প্রাথমিক শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরে সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৫ হাজার ৯৪৬টি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, ১৭ হাজার ১৬৪টি ওয়াশব্লক নির্মাণ, ৪ হাজার ৪৫০টি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৯ কোটি ১৯ লক্ষ ৫০ হাজার ৪৯২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শতভাগ শিক্ষার্থীকে ইএফটির মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পাঠ্যপুস্তকে বরাদ্দ ১ হাজার ৬২৬ কোটি
বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সংশোধিত পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের সরবরাহের জন্য ১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন।
তিনি বলেন, “উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, আধুনিক ও বিশ্বমানে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক মানের আউটকাম বেইজড এডুকেশন (ওবিই) পদ্ধতিতে
কারিকুলাম হালনাগাদ করা হয়েছে।
“মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতায় ৬২টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫১ লাখ, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৮ লাখ এবং স্নাতক পর্যায়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বোনাস বৃদ্ধি এবং গ্রাচ্যুইটি প্রদানসহ সকল স্তরের শিক্ষকদের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।”
এবতেদায়ী শিক্ষকদের জন্য সুখবর
বাজেটে প্রাথমিক পর্যায়ের মাদ্রাসা ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের জন্য সুখবর দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি এবতেদায়ী পর্যায়ে বৃত্তি প্রদান এবং মাদ্রাসাগুলোর এমপিওভুক্তি বাবদ ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে ১ হাজার ১৩৫টি মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৫১৩টি বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। ৪৯৩টি মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে।”
লক্ষ্য কারিগরি শিক্ষায় ২০ শতাংশ এনরোলমেন্ট
বাজেট বক্তৃতায় কারিগরি শিক্ষা এনরোলমেন্ট হার বাড়ানোর লক্ষ্য তুলে ধরেছেন অর্থ উপদেষ্টা।তিনি বলেন, “বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্টের হার ১৯ শতাংশ। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ২০ শতাংশে উন্নীত করতে প্রতিটি বিভাগীয় পর্যায়ে মহিলা পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জেলা পর্যায়ে পলিটেকনিক এবং উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।”