বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে গণশুনানি প্রক্রিয়া বন্ধ করেছিল আ. লীগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেছেন, জবাবদিহিতা এড়ানোর জন্য বিগত সরকার বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে গণশুনানির প্রক্রিয়া বন্ধ করেছিল। বিইআরসিকে পাস কাটিয়ে ইচ্ছেমতো তারা দাম নির্ধারণ করতো। বর্তমান সরকারের উচিত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন-২০০৩ এর অধীনে জ্বালানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণের গণশুনানি প্রক্রিয়া চালু করা।
শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) এফডিসিতে ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’ কর্তৃক বিগত সরকারের আমলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি নিয়ে আয়োজিত এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রতিযোগিতায় প্রস্তাবের পক্ষে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ ও বিপক্ষে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকরা অংশগ্রহণ করেন। বিতর্ক শেষে বিজয়ী হয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
ম. তামিম বলেন, বিপিসি জ্বালানি খাতের সবচাইতে অস্বচ্ছ একটি প্রতিষ্ঠান। এই অস্বচ্ছতা পেছনে সরকারেরও সংশ্লিষ্টতা ছিল। কারণ তেল বিক্রি যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা হতো, সরকার চাইতো না তা প্রকাশ হোক, ফলে লোকসান দেখিয়ে দেখিয়ে দফার দফায় তেলের দাম বৃদ্ধি করতো। বর্তমান সরকারও বিপিসির অস্বচ্ছতা কাটাতে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়নি, যা দ্রুতই গ্রহণ করা উচিত।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা সহসাই কমবে না। ইতোমধ্যে ভারত-নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু চাইলে আমাদের দেশ থেকেও বিদ্যুৎ সেসব দেশে রপ্তানি করা সম্ভব। বর্তমানে দেশে শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা ৭ হাজার মেগাওয়াট, যেটা গরমকালে হয় ১৩ হাজার মেগাওয়াট।বাকি বিদ্যুৎ যারা উৎপাদন করতো, সেসব প্ল্যান্ট কিন্তু এখন বসে আছে এবং ৪ মাস ধরে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। কিন্তু এসময়টায় বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যদি নেপালে রপ্তানি করা যায়, তাহলে তা একটি ভালো উদ্যোগ হবে। কারণ নেপালের প্রচণ্ড শীতে অনেক জলবিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়,ফলে তাদের বাড়তি বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ডাকাতরা বাংলাদেশে আর্থিক খাতের মত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতেও অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল। লুটেরাদের সুযোগ করে দিতে ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিতর্কিত ইনডেমনিটি আইন পাস করেছিল, যার মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়ে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও বিতরণ, সঞ্চালন ও মিটার কেনাকাটার নামে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছিল। যাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য মিলেছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা ও চাহিদা কতটুকু তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। গত সাড়ে ১৫ বছরে কোনো ছাড়পত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই কোনো কাজে আসেনি। বিগত সরকার সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। ফলে যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো তা সঞ্চালন লাইনের অভাবে বিতরণ সম্ভব হতো না। ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হওয়া স্বত্বেও লোডশেডিং থেকে আমাদের মুক্তি মিলেনি। শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে বলে বিগত সরকার মানুষকে মিথ্যা গল্প গুনিয়েছে। ফেরি করে বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলা হলেও বিদ্যুতের ফেরিওয়ালারা এখন জেলে অথবা পলাতক। বিদ্যুতের এমন মিটার বসিয়েছে বাতি না জ্বললেও মিটার ঘোরে। প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করার সাথে সাথে এক চতুর্থাংশ টাকা মিটার খেয়ে ফেলে। শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাসের পাইপে গ্যাসের পরিবর্তে বাতাস দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এছাড়া আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিটি সম্পূর্ণ একপাক্ষিক ও দেশবিরোধী। এতে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়নি। জনগণকে পাশকাটিয়ে গোপনীয় ভাবে আদানি গ্রুপের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরকারী তৎকালীন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান চুক্তির কপি না দেখেই স্বাক্ষর করেছেন বলে জানা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তিটি প্রকাশ করলে মানুষের মধ্যে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তবে যেহেতু ভারত থেকে এই বিদ্যুৎ কেনায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত, তাই সরকার এই চুক্তি বাতিলের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আরও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ রইস, সাংবাদিক শাহনাজ বেগম, ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক রফিকুল বাসার, সাংবাদিক রিশান নসরুল্লাহ প্রমুখ।