ডার্ক মোড
Monday, 30 December 2024
ePaper   
Logo
প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বার বার পরিবর্তন হচ্ছে

প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বার বার পরিবর্তন হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অবসরে পাঠানো পাঁচ অতিরিক্ত সচিবকে বিভিন্ন দপ্তরের সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় গত ১৭ আগস্ট। এক দিন পরই ১৮ আগস্ট সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তাদের ‘সিনিয়র সচিব’ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

আবার এই পাঁচজনের মধ্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া এম এ আকমল হোসেন আজাদকে তিন দিনের মাথায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বদলি করা হয়। রেলের সচিব পদে আনা হয় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আব্দুল বাকীকে।

একইভাবে ১৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ পান মো. মোকাব্বির হোসেন। তিন দিনের মাথায় ১৭ আগস্ট তাঁকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।

জনপ্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এভাবে ঘন ঘন চলছে সিদ্ধান্ত বদল। কোনো পদে কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার আদেশ জারির ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত বদল করা হচ্ছে। কয়েকজন সাবেক সচিব সমকালকে বলেন, এসব ঘটনা প্রশাসনের ভেতরের অস্থিরতারই প্রকাশ। এতে প্রমাণ হয়, যথাযথ সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়নি। তাই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্য সিদ্ধান্ত বদলের প্রয়োজন হচ্ছে।

প্রশাসনে দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলের সর্বশেষ ঘটনা জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘটেছে। গত সোম ও মঙ্গলবার দুই দফায় দেশের ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি দিয়ে এরই মধ্যে দু’দফায় তা সংশোধন করা হয়েছে।

আবার খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোনো পদে উপযুক্ত কর্মকর্তা বাছাই না করে সেই পদে কর্মরতদের দ্রুততার সঙ্গে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ডিসি ফিটলিস্ট চূড়ান্ত না করে একযোগে ২৫ ডিসি মাঠ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। একইভাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব সরানো হয় সেই পদে কাউকে নিয়োগ না দিয়েই। এখনও সাতটি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ, দুটি বিভাগীয় কমিশনার ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরসহ অন্তত ১২টি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদ শূন্য।

কাজের গতি কমেছে

প্রশাসনে কর্মরত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় স্বীকার করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কাজের গতি দারুণভাবে কমেছে। যদিও প্রশাসনের সব পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে কাজের গতি বাড়াতে সচিবদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ৪ আগস্ট সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে এই নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সচিবদের দ্রুত কাজ করারও নির্দেশ দেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমলাদের বড় একটি অংশ গত সরকারের আমলে সচিব হওয়ায় তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। কয়েকজন সমকালকে বলেন, সরকার তাদের আস্থায় নিয়েছে কিনা তা তারা বুঝতে পারছেন না। এ অবস্থায় উদ্যোগী হয়ে কোনো সংস্কারের কাজে হাত দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

অন্যদিকে সরকারের শীর্ষমহল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক বৈঠকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার মদদপুষ্ট প্রশাসন ভেঙে ফেলতে হবে। সেখানে নিয়োগ দিতে হবে বঞ্চিতদের। এর অংশ হিসেবে কাউকে কাউকে নিয়োগ দেওয়াও হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পদ-পদবি ঠিক থাকবে কিনা তা নিয়ে আতঙ্কে আছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

দেখা গেছে, সচিবালয়ে এখনও অস্থিরতা চলছে। যোগ্যতা থাক আর না থাক, মনের মতো পদ না পাওয়া নিয়ে সচিব থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত সবাই এখন আগের সরকারের ‘বৈষম্যের শিকার’ বলে দাবি করছেন। তাদের দাবি ও বিক্ষোভের মুখে অনেকে পদ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন। যারা আছেন, তারাও ভয়ে আছেন।

ডিসি পদায়নে তালগোল

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান গতকাল সচিবালয়ে তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, শরীয়তপুর, দিনাজপুর ও রাজবাড়ী– এই আট জেলায় মঙ্গলবার যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি-২ এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান (জয়পুরহাট) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফারহানা ইসলামকে (কুষ্টিয়া) ডিসি হিসেবে বদলির আদেশও বাতিল করা হয়েছে। এ দু’জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সোমবার।

গতকাল যে চার জেলায় ডিসি পদে রদবদল আনা হয়েছে, তার মধ্যে টাঙ্গাইলের ডিসিকে পঞ্চগড়, নীলফামারীর ডিসিকে টাঙ্গাইল, নাটোরের ডিসিকে লক্ষ্মীপুর এবং পঞ্চগড়ের ডিসিকে নীলফামারীতে বদলি করা হয়েছে।

মোখলেস উর রহমান বলেন, একটি বাছাই কমিটির মাধ্যমে ডিসিদের ফিটলিস্ট হয়। সেই কমিটি আজকে বসেছিল। পর্যালোচনা করে ইমিডিয়েট যেটা হয়েছে, ইতোমধ্যে ৮ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

সমন্বয়ক নামে ডিসি নিয়োগে হস্তক্ষেপ!

ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দাবিদার তানভীর আহমেদ নামে এক ব্যক্তির পরামর্শক্রমে ডিসির তালিকা চূড়ান্ত করার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তিনি জনপ্রশাসনের যুগ্ম সচিব কে এম আলী আজমের কক্ষে গত কয়েক দিন আসা-যাওয়া করেন।

বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি, তানভীর ও আলী আজম একাধিক দিন সচিবালয়ে তাঁর কক্ষে রাত ২টা পর্যন্ত একান্তে বৈঠক করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুসারে, কে এম আলী আজম ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দাবিদার তানভীরকে স্যার সম্বোধন করেন।

কে এম আলী আজম দাবি করেছেন, তিনি কোনো সমন্বয়কের সঙ্গে মিটিং করেননি। তিনি বলেন, তানভীর আমার কাছে আসেন। আমি তো ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডাকিনি। কেউ এলে তাঁকে কি নিষেধ করা যায়?

অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, একজন সমন্বয়ক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এসে মাতব্বরি করে এমন খবর আমরা পেয়েছি।

তিনি জানান, গত সপ্তাহের বুধবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আসেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। তখন তানভীরের বিষয়ে আমরা নাহিদ ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তখন নাহিদ ইসলাম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তানভীরকে পাত্তা দেওয়া যাবে না।

গতকালও বঞ্চিতদের মহড়া

ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন দুটি বাতিলে গতকালও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে মহড়া দিয়েছেন বঞ্চিতরা। তারা বিকেল ৫টার মধ্যে প্রজ্ঞাপন বাতিল চেয়েছিলেন। যদিও তা হয়নি। দুপুরে জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা। জেলা প্রশাসকপ্রত্যাশী উপসচিবদের সমন্বয়ক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নূরুল করিম ভূঁইয়া বলেন, সিনিয়র সচিব প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ৫৯ জন ডিসিকে যে পদায়ন করা হলো তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ রয়েছে, আপত্তি রয়েছে।

তদন্ত কমিটি গঠন

ডিসি নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের হট্টগোল করার ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য জানানো হয়। এক সদস্যের কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদকে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে তিনি প্রতিবেদন জমা দেবেন।

‘যারা ডিসি হন নাই, তাদের ইজ্জতহানি হয় নাই’

তদন্ত কমিটির প্রধান আকমল হোসেন আজাদ গতকাল বিকেলে বলেন, ‘যারা ডিসি হন নাই, তাদের তো পদাবনতি হয়নি, তাই তাদের ইজ্জতহানিও হয় নাই।’

সচিবালয়ে ডিসি হতে ইচ্ছুকদের বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি বিভিন্ন নিউজ দেখে সাধারণভাবে মনে করি, এটা শোভন হয়নি। তালিকায় নাম থাকলেই যদি তারা মনে করেন যে, তারা ডিসি হয়েছেন, এটা ঠিক নয়।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন