ডার্ক মোড
Thursday, 19 September 2024
ePaper   
Logo
প্রধান বন সংরক্ষকের সিন্ডিকেট থেমে নেই দুর্নীতি ও বদলী বানিজ্য

প্রধান বন সংরক্ষকের সিন্ডিকেট থেমে নেই দুর্নীতি ও বদলী বানিজ্য

এ.বি. রাজ্জাক

বন বিভাগ যেন গভীর বনের মতোই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে। এই সেক্টরে দুর্নীতি ও লুটপাট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা সহজে প্রকাশ পায় না। সুফল প্রকল্প, বনায়ন প্রকল্প কিংবা রাজস্ব খাতের বরাদ্দের টাকা কাগজে-কলমে কাজ দেখিয়ে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। রেঞ্জ কর্মকর্তা, স্টেশন কর্মকর্তা ও বিভাগীয় কর্মকর্তারা ঘুষের মাধ্যমে পোস্টিং নিয়ে জবরদখলে সরাসরি সহযোগিতার করায় সংকুচিত হচ্ছে বনভূমি ,নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী এবং অভয়ারণ্য‌। হারিয়ে গেছে বিলুপ্ত প্রজাতির প্রায় শতাধিক প্রাণী, চরম সংকটে পড়েছে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রকৃতি।

অভিযোগে প্রকাশ, প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী সিন্ডিকেটে পোস্টিং বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এ কারণে বন বিভাগ আজ ধ্বংসপ্রায়। তার সিন্ডিকেটের অন্যতম দুজন সদস্য হলেন- চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদ্য বদলি হওয়া বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ রায় এবং ঢাকা সামাজিক বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক এসএম মনিরুল ইসলাম। এই দুর্নীতি চক্রের নেপথ্যে ছিলেন সাবেক বনমন্ত্রী সাহাব উদ্দিন এবং তার ছেলে জাকির হোসেন জুমন।

বন বিভাগের নির্ভরযোগে একটি সূত্র জানায় , পোস্টিং বাণিজ্যের মাধ্যমে সাবেক বন মন্ত্রী সাহাব উদ্দিনের আমলে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকা বাণিজ্য করেছে প্রধান বন সংরক্ষকের এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের নৈপথ্যে নায়ক ছিলেন মন্ত্রী সাহাব উদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেন জুমন। বাবা মন্ত্রী হওয়ার পরই জুমন লন্ডন থেকে দেশে চলে আসেন। ঢাকায় বাবার বাসায় থেকে মন্ত্রণালয় ও বনবিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করেন জুমন। মাত্রাতিরিক্ত ঘুষ গ্রহণের কারণে তাকে বনবিভাগের অনেকেই জুম্মন কসাই হিসেবে চিনেন বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।

বদলী বাণিজ‍্যে বৈষম্যের শিকার মাঠ পর্যায়ের একাধিক ফরেস্টার ও বন প্রহরীরা জানান, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের দোসর প্রধান বন সংরক্ষকের বিরুদ্ধে ঢাকার বন ভবনে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই প্রধান বন সংরক্ষক কৌশলে বৈঠকের মাধ্যমে সবাইকে শান্ত করেন। তাদের দাবী, এখনো পোস্টিং বাণিজ‍্যের মাধ্যমে সিনিয়র ফরেস্টারদের রেঞ্জ এবং চেক পোষ্টের দায়িত্ব না দিয়ে জুনিয়র ফরেস্টার এবংজ ফরেস্ট গার্ডদের ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে। পোস্টিং বৈষম‍্য সমাধান না হলে যে কোন সময় কঠোর আন্দোলন হতে পারে বলে ধারনা করছেন মাঠ পর্যায়ের বন রক্ষকরা।

সূত্রটি আরো জানায় কর্মকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী বন অঞ্চলের বিভিন্ন রেঞ্জ, স্টেশন ও বিভাগীয় বনবিভাগকে বনভূমি অনুযায়ী প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে ভাগ করা থাকে। দুই বছরের জন্য প্রথম শ্রেণীর বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য ১৫ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর রেঞ্জ কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য জন্য ১০ লাখ ও তৃতীয় শ্রেণীর রেঞ্জ কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য নেয়া হয় ৫ লাখ টাকা।

এছাড়াও এক বছরের প্রথম শ্রেণীর চেকপোস্টে স্টেশন কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য ২০ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেনীর চেকপোস্টে স্টেশন কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য ১০ লাখ টাকা ও তৃতীয় শ্রেণীর চেকপোস্টে স্টেশন কর্মকর্তাদের পোস্টিংয়ের জন্য নেওয়া হয় ৫ লাখ টাকা।দুই বছরের জন্য প্রথম শ্রেণীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য ৫০ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তার পোস্টিংয়ের জন্য ৩০ লাখ টাকা ও তৃতীয় শ্রেনীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের পোস্টিংয়ের জন্য নেওয়া হয় ২০ লাখ টাকা করে।

শুধু পোস্টিং বাণিজ্যেই সীমাবদ্দ নেই এই সিন্ডিকেট। বদলী নীতিমালা অনুযায়ী স্টেশন পোস্টিংয়ের এক বছর ও রেঞ্জ এবং বিভাগীয় কর্মকর্তার পোস্টিংয়ের দুই বছর মেয়াদ শেষ হলে শুরু হয় নতুন বাণিজ্য। নির্দিষ্ট মেয়াদ পেরিয়ে গেলে নতুন পোস্টিং না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে রেঞ্জ কর্মকর্তা, চেক স্টেশন কর্মকর্তা ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের মাসিক মাসোহারা দিতে হয় বলে জানিয়েছেন খোদ বন বিভাগের এই কর্মকর্তারা।

এদিকে, বিপুল কৃষ্ণ দাসের বদলির আদেশ হাতে আসার আগে গত ২৫ জুলাই কোটি টাকার বিনিময়ে তার নিজস্ব বলয়ের প্রায় ডজন খানেক ফরেস্টারকে লোভনীয় পদে পোস্টিং দেন। তার মধ্যে দশ জনের তালিকা এসেছে প্রতিবেদকের হাতে। তাদের মধ্যে উপকূলীয় বনবিভাগের ফরেস্টার মোঃ মোজাম্মেল হক সরকারকে লামা বনবিভাগে, ফরেস্টার এইচ এম জলিলুর রহমানকে বান্দরবান বনবিভাগে ও খন্দকার আরিফুল ইসলামকে লামা বনবিভাগে। চট্টগ্রাম দক্ষিন বনবিভাগের মোঃ আরিফুল ইসলামকে পাল্পউড বনবিভাগে, আশরাফুল ইসলামকে লামা বনবিভাগে ও ফরেস্টার মোঃ মঞ্জুর মোর্শেদকে ব্যাবহারিক বন বিভাগে। পাল্পউড বন বিভাগের ফরেস্টার অভিজিত কুমার বড়ুয়াকে ব্যাবহারিক বন বিভাগে, ব্যাবহারিক বন বিভাগের ফরেস্টার মোঃ রাফি উদ দৌলা সারদারকে বান্দরবান বনবিভাগে, লামা বনবিভাগের ফরেস্টার এস এম রেজাউল ইসলামকে চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগে পোস্টিং দেওয়া হয়।

বনবিভাগের বদলী নীতিমালা ২০০৪ অনুযায়ী, চেক স্টেশনে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা এক বছর, রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এক কার্যালয়ে দুই বছর জন্য দায়িত্ব পালনের বিধান রয়েছে। অভিযোগ আছে, কোন কোন চেক স্টেশনে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত বদলী নীতিমালা বহির্ভূত অতিরিক্ত সময়ের মাসোহারা দিয়ে দায়িত্ব পালন করেন কর্মকর্তারা। যদিও চেকস্টেশনের কর্মকর্তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের বেলায় এক বছরের বদলী নীতিমালার দোহাই দিয়ে বদলী করা হয় বলে জানিয়েছেন অনেকেই। বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের এসব লোভনীয় পোস্টিংয়ের মধ্যে রয়েছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভাগ,চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ, চট্টগ্রাম বণ্যপ্রাণী ব্যাবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভাগ, বান্দরবান পাল্পউড বন বিভাগ, বান্দরবান বন বিভাগ, লামা বনবিভাগ। রাঙ্গামাটি অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগ, জুম নিয়ন্ত্রণ বনবিভাগ, ইউএসএফ বনবিভাগ ও খাগড়াছড়ি বনবিভাগ।

চেকস্টেশন কর্মকর্তাদের লোভনীয় পোস্টিয়ের মধ্যে রয়েছে, কুমিল্লা সামাজিক বনবিভাগের সোয়াগাজী ফরেস্ট চেক স্টেশন। খাগড়াছড়ি বনবিভাগের রামগড় ফরেস্ট চেক স্টেশন। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের নলবিলা ফরেষ্ট চেক স্টেশন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের পুদয়া ও বড়দোয়ারা ফরেস্ট চেক স্টেশন। চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের রাউজান ঢালা চেক স্টেশন, হাটহাজারি ফরেস্ট চেক স্টেশন, ফৌজদার হাট ফরেস্ট চেক স্টেশন, করের হাট চেক স্টেশন ও ধুমঘাট ফরেস্ট চেক স্টেশন। ঢাকা সামাজিক বনবিভাগের সোনারগাও ফরেস্ট চেক স্টেশন।

টাঙ্গাইল বনবিভাগের করটিয়া ফরেস্ট চেক স্টেশন।রাঙ্গামাটি অঞ্চলের দক্ষিণ বনবিভাগের কাপ্তাই জেটি ঘাট চেক স্টেশন, ঘাগরা ফরেস্ট চেক স্টেশন ও সুবলং ফরেস্ট চেক স্টেশন। রেঞ্জ কর্মকর্তাদের লোভনীয় পোস্টিংয়ের মধ্যে রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভগের সদর রেঞ্জ। রাঙ্গামাটি বন বিভাগের সবগুলো রেঞ্জ। ঢাকা সামাজিক বনবিভাগ সদর রেঞ্জ। টাঙ্গাইল সদর রেঞ্জ। ময়মনসিংহ ভালুকা রেঞ্জ। ঢাকা বনবিভাগের কালিয়াকৈর রেঞ্জ ও শ্রীপুর রেঞ্জ। সুন্দরবন অঞ্চলের খুলনা রেঞ্জ, সাতক্ষীরা রেঞ্জ, চাদপাই রেঞ্জ ও শরণখোলা রেঞ্জ। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ঈদগাহ রেঞ্জ ও ফুলছড়ি রেঞ্জ। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের টেকনাফ রেঞ্জ, হোয়াইক্যং রেঞ্জ, উখিয়া রেঞ্জ ও রাজাপালং রেঞ্জ। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের পটিয়া রেঞ্জ, রাঙ্গুনিয়া ও শহর রেঞ্জ। চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের সবগুলো রেঞ্জ।

চট্টগ্রামের চুনতি বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জ ও বাশখালী বণ্যপ্রাণী রেঞ্জ। ঢাকা বণ্যপ্রাণী বিভাগের ভাওয়াল রেঞ্জ ও জাতীয় উদ্যান রেঞ্জ। নোয়াখালীর সকল উপকূলীয় রেঞ্জ। কোন ধরনের পোস্টিং বাণিজ্যে জড়িত নয় বলে জানান সদ্য বদলী হওয়া চট্টগ্রাম বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস বলেন।ঢাকা সামাজিক বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক এস এম মনিরুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্যি নয়। আমি যদি এসব ঘটনায় জড়িত থাকি তাহলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের যেকোন শাস্তি মেনে নিব।

প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। কেউ ব্যাক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এ ধরনের তথ্য দিয়েছে। আমি সরাসরি রেঞ্জ ও স্টেশন কর্মকর্তাকে পোস্টিং দিতে পারি না। আমি শুধু বিভাগে সংযুক্ত করাতে পারি। এরপর বাকীটা ডিএফও দেখেন। বড় বদলী গুলো মন্ত্রনালয় থেকেই হয়। অতএব আমার দপ্তরে পোস্টিং বাণিজ্য করার সুযোগ নেই।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন