নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের তাঁতশিল্পের দুরাবস্থা
নিজস্ব প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ
সামনে ফের ঈদ সিজন। সকল লোকসান পুষিয়ে নিয়ে নতুন করে নবউদ্যমে তাঁত ব্যবসার হাল ধরতে পারার স্বপ্ন দেখছেন নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার তাঁতীরা। গত ঈদ সিজনের বিল পায়নি তাঁতীরা। কোটা আন্দোলনের সময়েও গ্রে-কাপড় বিক্রি হয়নি। সবমিলিয়ে গত বছরটাই ভাল যায়নি। আর্থিক দুরাবস্থা যেনো কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা। সবমিলিয়ে ভাল নেই বৃহত্তর নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের (নরসিংদী-মাধবদী ও আড়াইহাজার ) তাঁতীরা। পাইকাররা কাপড় নিয়ে গেছে একমাস আগে। এখনো তাঁতী কিম্বা মিল মালিকদের বিল পরিশোধ করেনি। মিল মালিকরা তাঁতীদের মজুরী পরিশোধ করতে পারছেন না। এই শিল্পে রং, সুতা ও কাপড় ক্রেতা সিন্ডিকেট বিষাক্ত ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। এই সিন্ডিকেট এর হাত থেকে উদ্ধার পেতে হলে কাপড় বিক্রেতা অর্থাৎ মিল মালিকদেরকেও সিন্ডিকেট গড়তে হবে। এছাড়া কোন বিকল্প নেই। কেননা কোটি কোটি টাকার কাপড় বাকি নিয়ে কাপড় ক্রেতা সিন্ডিকেট কাপড়ের দাম ঠিক করে দেয়। কাপড় বিক্রেতা পক্ষ অর্থাৎ মিল মালিকরা কতটা জিম্মি হলে এমনটা সম্ভব। জিম্মি মিল মালিকরা শিল্পটিকে বাঁচাতে শক্ত হয়ে কথা বলতে পারেনা।
তাই সময়ের প্রয়োজনে এই সিন্ডিকেট প্রথাকে ভাঙ্গতে কাপড় উৎপাদনকারী মিল মালিকদেরকেও সিন্ডিকেট গড়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ। অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে। নইলে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী অঞ্চলের তাঁত শিল্পের মৃত্যু ঘন্টা বেজে যাবে বলে আশংকা করছে বাজার বিশেষজ্ঞরা। সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে সিন্ডিকেট গড়তে হবে।
জানাগেছে, আশির দশকের মধ্য সময়ে বড় ধরনের ধস নামে তাঁত শিল্পের। এরশাদ সরকার তাঁতিদের পূনঃজীবিত করতে তাঁত ঋন প্রদান করেন। ঋন প্রদানের বিপড়িতে কোনো জামানত না থাকায় বেশির ভাগ লোনই এদিক সেদিক হয়ে যায়। যে সকল তাঁতিরা ঋন পেয়েছে, তাহারাও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ধ্বংস হয়ে যায় তাঁত শিল্প, বিলুপ্ত হয় তাঁত। বেকার হয় তাঁতীরা। ঐতিহ্য হারায় নরসিংদির তাঁত শিল্প। শুরু হয় দেশীয় আব্দুল আলী ও নিজাম মাষ্টারের বানানো পাওয়ারলুমের। বিদ্যুৎ চালিত লুমে তৈরি হয় পলিষ্টার লোন ও ডাইট কাপড়। ২ টা ৪ টা করে দুঃসাহসিক ভুমিকা নিয়ে নরসিংদীতে শুরু হয় পাওয়ারলুম কারখানা। টিনের ছাপড়া ঘরে মুলি বাশের বেড়া দিয়ে চৌয়ালায় শুরু হয় প্রথম এই পাওয়ারলুম।
যা আজকের ঐতিহ্যমন্ডিত টেক্সটাইল শিল্প। অত্যাধুনিক চায়না,জাপানি ও কুরিয়ান সাংলী,কগজি কোম্পানির পাওয়ারফুল পাওয়ারলুম মেশিন। এই শিল্প আজ নরসিংদী বিস্তৃত। শিল্প সমৃদ্ধ নরসিংদী জেলায় হাজার টেক্সটাইল মিল স্থাপিত হয়েছে। এই মিলের উৎপাদনে দেশের সর্ব সাধারণের ৭৩% কাপড়ের চাহিদা পূরন হচ্ছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে জাতি। পাশাপাশি স্থাপিত হচ্ছে বস্ত্র প্রক্রিয়াজাত করণের সংশ্লিষ্ট শিল্প সমূহ। যেমন- সুতা তৈরির স্পিনিং মিল, সাইজিং মিল, ছাপাখানা,ফিনিশিং, প্রসেসিং মিল।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যে শিল্প ঘিরে সকলে চলে সেই টেক্সটাইল মিল আজ লোকসানের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্তিত্ব হারা হয়ে যাচ্ছে টেক্সটাইল শিল্প মালিকরা। ব্যাংক ঋণে জর্জরিত সকল টেক্সটাইল মিল মালিকগণ। দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ার কারনে এ শিল্পের মালিকরা জিম্মি হয়ে গেছে দুই শ্রেণির ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে। এক, স্পিনারদের লাগামহীন দৌরাত্ম্যের কাছে। খুশি খেয়াল মত সুতার দাম বৃদ্ধি করা তাদের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।
তাদের সাথে সখ্যতায় মাধবদী ও নারায়নগঞ্জের সুতা ব্যবসায়ীরা এক ও অভিন্ন। দুই, কাপড় ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা বাকী নিয়ে এখন ইচ্ছে মত কাপড়ের মূল্য নির্ধারণ করে তারা। কি অবাক কান্ড!! উৎপাদন আমার, দাম নির্ধারণ করে দাদারা। তাঁতি মানে বোকা, ব্যাঙ, জোলা, এসব উপাধি প্রদান করে। কারণ, জিম্মি তো ওদের সিন্ডিকেটের কাছে।