
নাগরিক সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ ফরিদপুর শহর কতটা বাসযোগ্য
মাহবুব পিয়াল, ফরিদপুর
ফরিদপুর জেলা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলায় পর্তুগীজদের আগমনের পর বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রসারের জন্য জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ নামে একজন মুসলিম শাসকের নামে এ অঞ্চলে ‘ফতেহাবাদ’ নামে একটি জমিদারি অঞ্চলের প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তীতে শাহ ফরিদ (রহঃ) এর আগমনের পর তার নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয় ফরিদপুর। পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত জেলা শহরটি বর্তমানে আধুনিকতার পথে হাঁটলেও এই ফরিদপুর বসবাসের জন্য কতটা উপযোগী? নগর জীবনের সুযোগ-সুবিধা, যানজট, দূষণ, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান - সবকিছু মিলিয়ে ফরিদপুর কি আজকের দিনে একটি আদর্শ বাসস্থানের ঠিকানা হতে পারে?
ফরিদপুর জেলায শহরে নাগরিকদের উন্নত চিকিৎসার সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, একটি আধুনিক সরকারি সদর হাসপাতাল এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাইভেট হসপিটাল। এছাড়াও রয়েছে পাঁচটি সরকারি কলেজ, একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, এবং দুইটি বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান—ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ফরিদপুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের উচ্চমানের প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে।
ফরিদপুর জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সময়ের সাথে উন্নত হলেও, এখনও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। এই ভাঙাচোরা রাস্তাগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের চলাচলে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি করছে।
ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলা শহরে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ভাঙ্গা-ফরিদপুর মহাসড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। রাস্তায় বড় বড় গর্ত আর ভাঙ্গাচোরার কারণে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দ্রুত এই সড়কটির সংস্কার করা না হলে, এটি ফরিদপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
ফরিদপুর শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হল অতিরিক্ত জনসংখ্যা। ২০০৯ সালে পৌরসভার জনসংখ্যা ছিল ১,৩৫,৮৩৭ জন, যা প্রতি বছর গড়ে ৩.৯১% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারণা করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে শহরের জনসংখ্যা বেড়ে ৩,২১,৯২২ জনে পৌঁছাবে।
জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি শহরের অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। রাস্তাঘাট ও বাজার এলাকাগুলোতে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই থাকে, ফলে পথচারীদের চলাচলে অসুবিধা হয়। বিশেষ করে, সরু রাস্তা ও বেহাল সড়ক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে জনবহুল এলাকায় চুরি ও পকেটমারের ঘটনা ঘটে, যা নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন নির্জন স্থানে পর্যাপ্ত লাইট ও সিসি ক্যামেরা না থাকার প্রায়ই ছিনতাইয়ের মত ঘটনা ঘটছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও নগর ব্যবস্থাপনার উন্নতি না হলে ফরিদপুর শহরের বাসিন্দাদের ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে।
ফরিদপুর শহরের মধ্যে চলাচলের প্রধান মাধ্যম রিক্সা বা থ্রি হুইলার অটো। তবে যাত্রীর তুলনায় এসব যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। অতিরিক্ত অটোরিকশার কারণে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেমন—জনতার মোড়, ভাঙ্গা রাস্তার মোড়, রেফেলসের মোড়, আলিপুর গোরস্থান, সদর হাসপাতাল রোড, টেপাখোলা গরুর হাট রোড ও মেডিকেল কলেজ রোডে দিনের অধিকাংশ সময় যানজট লেগে থাকে। ফলে পথচারী ও যানবাহন চলাচলে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসনে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামী দিনে ফরিদপুর শহরের চলাচল ব্যবস্থা আরও সংকটাপন্ন হতে পারে।
এছাড়াও শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বেড়েছে ভ্রাম্যমান হকারদের দৌরাত্ম্য। শহরের প্রাণকেন্দ্র জনতার মোড়ে ফুটপাত ও সড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভ্রাম্যমান দোকানপাট। যা যানজট এবং পথচারীদের চলাচলের সমস্যার অন্যতম কারণ। এছাড়াও কুমার নদীর উপর নির্মিত বেইলি ব্রিজও ভ্রাম্যমান হকারদের দখলে।
হকারদের পুনর্বাসন এবং বিকল্প জায়গা না থাকায় প্রশাসনের সদিচ্ছা সত্তে¡ও এ সমস্যার দীর্ঘস্থায় কোন সমাধান হচ্ছে না। ফরিদপুর শহরের বায়ু ও শব্দ দূষণ এখন চরমে। সিএনবি ঘাটে বালু উত্তোলনের কারণে শহরের প্রধান সড়ক ধুলোয় আচ্ছন্ন। টেপাখোলা গরুর হাট থেকে সিএমবি ঘাট পর্যন্ত রাস্তা শ্বাস নেওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বালু বোঝাই ট্রাকগুলো যানজট ও দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফরিদপুরে তেমন বড় শিল্প কারখানা নেই বললেই চলে। এজন্য প্রথাগত পেশার বাইরে এখানকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও তাই বেশ সীমিত। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শিক্ষক, আর চিকিৎসক ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই এখানে নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পড়েন।
যানজট নিরসন, রাস্তা সংস্কার, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ফরিদপুর শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান আরও অবনতি হতে পারে। প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ, নাগরিক সচেতনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে ফরিদপুরকে আরও বাসযোগ্য শহরে পরিণত করা সম্ভব।