
তিন কন্যার সাফল্য গাথা ও একজন গর্বিত বাবার গল্প
নিজস্ব প্রতিবেদক
মৌরি, প্রিয়াংকা আর সুনেহরা- এই তিন কন্যার সাফল্যে তাদের বাবা ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এবং মা শামিম সুলতানা পপির মুখে আজ গর্বের হাসি। বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে ছেলে সন্তানকে এখনো সংসারের প্রদীপ বলা হয়, সেখানে মাহবুবুর রহমানের সংসারে সত্যিকারের প্রদীপ জ্বেলেছে তার তিন কন্যা মৌরি-প্রিয়াংকা-সুনেহরা। মেয়েদের সাফল্যরে আলোয় আলোকিত আজ তার সংসার। সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে তিনি কখনো কোন কার্পণ্য করেননি। ঠিক তেমনি মেয়েরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফলতার সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবার মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে প্রতিনিয়ত। মাহবুবুর রহমানের তিন মেয়েই স্বমহিমায় দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে অবিরত।
মাহবুবুর রহমান বলেন, আমার তিনটি মেয়েই আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার এক অনুপম আশির্বাদে পরিগণিত হয়েছে। তারা নারীদের জন্য সামাজিক প্রত্যাশার প্রতিবন্ধকতার সীমানা পেরিয়ে নিজেদের উচ্চাকাঙ্খ্যা পূরণ করতে ব্যতিক্রমভাবে সমর্থ হয়েছে।আমার তিনটি মেয়েই আমার কাছে একেকটা রত্ন। ওদের নিয়ে সত্যিই আমার অনেক গর্ব হয়। আমি মনে করি, আমার মেয়েদের সফলতার কাহিনী অনেক মেয়েদের স্বপ্ন পূরণে উৎসাহ যোগাবে আর অনেক বাবা-মাকে তাদের মেয়েদের নিয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখাবে।
মাহবুবুর রহমানের বড় মেয়ে সৈয়দা সিমা মৌরি। মৌরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার মেয়ে মৌরির জীবন সংগ্রামের গল্পটি সহনশীলতা ও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের একটি বিরল দৃষ্টান্ত। মৌরি Utrecht University, Netherlands এর হিউম্যান জিওগ্র্যাফি ও স্পেশাল প্ল্যানিং এর অধীনে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন (International Development)- এ পিএইচডি অর্জন করেছে। তার গবেষণার বিষয় ছিল নারীদের নিরাপত্তা ও পাবলিক স্পেসে তাদের প্রবেশাধিকার নিয়ে। তার গবেষণাটি বাংলাদেশ, ভারত আর নেদারল্যান্ডের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে সে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Post Doctoral করার জন্য Full Scholarship অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাপী কোভিড ১৯ চলাকালীন সময়ে সে তার লিভারের অংশ দান করে আমাকে নতুনভাবে জীবন দিয়েছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি এখনো সুস্থভাবে বেঁচে আছি আমার মৌরির দেওয়া লিভারের কারণে। পরিবারের প্রতি পরম শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ এবং ত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমার মেয়ে মৌরি। বাবা হিসেবে তাকে নিয়ে সত্যিই আমি অনেক গর্বিত।
মেজ মেয়ে সৈয়দা ফারিহা প্রিয়াংকা সম্পর্কে মাহবুবুর রহমান বলেন, আমার মেয়ে প্রিয়াংকা একমাত্র বাংলাদেশি, যে বর্তমানে ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংকে পরিচালক পদে কর্মরত। সে লোন সিন্ডিকেট এবং বিতরণ বিভাগের নেতৃত্বে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছে ঋণ বিতরণ ও প্রতিস্বাক্ষরে তার দায়িত্ব- এটা সত্যিই অনেক বড় গর্বের বিষয়। এ গর্ব শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বাংলাদেশের। এছাড়াও প্রিয়াংকা ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত “মে ব্যাংক গো এ্যাহেড” চ্যালেঞ্জ এ বিশ্বের ১০ টি দেশের ৫৪ জন প্রতিযোগীর মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশর মুখ উজ্জ্বল করেছে। এই প্রতিযোগিতায় তার দল চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রাইজমানি হিসেবে ৩০ হাজার ডলার পুরষ্কার লাভ করে। মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, পরিবার তথা বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমার এই মেয়েটিও পিছিয়ে নেই। আমার স্ত্রীর ক্যান্সারের চিকিৎসা এবং আমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচের ব্যয়ভার প্রিয়াংকা আর মৌরি দু’জনে মিলে বহন করে চলেছে তাদের উপার্জিত অর্থে। আমি আল্লাহর কাছে অসীম কৃতজ্ঞ যে তিনি এতো উত্তম সন্তান আমাকে দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেখানে হরহামেশাই খবরের কাগজে দেখতে পাই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের অবহেলার হৃদয়বিদারক কাহিনী সেখানে আমার সন্তানেরা অন্যরকন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং করে চলেছে অবিরত। একথা বলেই অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়ে তিনি বলেন, আমি সত্যিই অনেক ভাগ্যবান একজন বাবা।
এরপরে মাহবুবুর রহমান তার ছোট মেয়ে সৈয়দা সুনেহরা আফসারাকে নিয়ে বলেন, আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটিও অত্যন্ত বিনয়ী ও মেধাবী। সে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছে। সে লিঙ্গ, জাতি, যৌনতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারকে পড়াশোনার প্রধান বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। বর্তমানে সে একাডেমিক পোর্টফোলিওর অধীন “হেলথ এন্ড ওয়েলনেস” পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছে।
মেয়েদের ব্যাপারে সবশেষে মাহবুবুর রহমান বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়ে তিনটি ছিলো অত্যন্ত নম্র, ভদ্র এবং মেধাবী। বড় হয়ে তিনবোনের প্রত্যেকেই তাদের নির্বাচিত ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যময় পার্থক্য তৈরি করেছে যা আমাদের জন্য সত্যিই এক অসীম গর্বের কারণ। তারা তিনবোন তাদের স্ব স্ব স্থানে প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধা ও মননের অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছে। আমার মেয়েদের এই কাহিনী শিক্ষার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারীর সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন। তিনি বলেন, আমার মৌরি, প্রিয়াংকা আর সুনেহরার কাহিনী হয়তো হতে পারে একটি মহান অনুপ্রেরণা যা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
সন্তানদের সাফল্যের কাহিনী বর্ণনা করার সময় মাহবুবুর রহমানের চোখে-মুখে অন্যরকম এক আনন্দ খেলা করছিলো। মাঝে মাঝেই তার চোখগুলো আনন্দাশ্রুতে ভিজে যাচ্ছিল। সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে এবং সন্তানরা তাদের কর্মক্ষেত্রে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে সব বাবাদের বুক গর্বে ভরে ওঠে। মাহবুবুর রহমান তাই আজ এতো গর্বিত একজন পিতা। ভালো থাকুক মাহবুবুর রহমান ও তার তিনকন্যা মৌরি, প্রিয়াংকা, সুনেহরা।