জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণীয় শিক্ষা সফর
মনিরুজ্জামান বাদল
আজ আমার জীবনের ভ্রমণ কাহিনির মধ্যে শ্রেষ্ঠ একটি কাহিনি শিক্ষা সফর। আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স প্রোগ্রামের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। সেই হিসেবে আমিও শিক্ষা সফরের একজন প্রান্তিক যাত্রী। বাস ধীরে ধীরে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে নবাবপুর রোড হয়ে যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের দিকে দ্রুত বাস এগিয়ে চললো নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁও পানামা নগরের উদ্দেশ্যে। আমরা সকাল নয়টার মধ্যে পানামা নগরের খুব কাছাকাছি চলে গেলাম। বাস রিসোর্টের কাছাকাছি পৌঁছাতেই সবার কাছে মনে হলো যেন সমুদ্র জয় করে আসছে, কারণ প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের মনে একটা টানটান উত্তেজনা কাজ করেছে। বাসচালক এতটাই বেপরোয়া ছিল, সমস্ত রাস্তায় মনে হয়েছিল এই বুঝি এক্সিডেন্ট করবে- করবে ভাব, সত্যি কথা হলো বাসচালক অত্যন্ত দক্ষ একজন চালক। খুব দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করলেও তার কন্ট্রোলিং পাওয়ার ছিল প্রশংসার দাবিদার।
পানামা নগরের পাশেই রয়েছে একটি লেইকপাড়, লেইকের উপর রয়েছে নান্দনিক ধনুকের মত বাঁকানো কংক্রিটের ব্রীজ। আমরা ব্রীজ পার হয়ে লেইকের বিপরীত পার্শ্বে। যথারীতি সবাই বাস থেকে নেমে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখতেই শিক্ষক ও সকল শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা গ্রুপ ছবি তুলে নিলাম।
ধীরে ধীরে সবাই টিকেট কাউন্টারে যেয়ে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করবে। ভেতরে প্রবেশদ্বারের একপ্রান্তে রয়েছে শ্বেত পাথরের উপর খুদাই করে রচিত পানামা নগরের ইতিকথা। কেউ কেউ খুব আগ্রহভরে পড়ে নিলো। আমিও জানার আগ্রহে সম্পূর্ণ আর্টিকেল পড়ে নিলাম। ভেতরে প্রবেশ করেই যেই বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। সেটা হলো সেখানে মোট ৫২ টি ভবন রয়েছে। প্রতিটি ভবন খুবই ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভবনের ছাদ থেকে প্রাচীন ইটগুলো খুলে খুলে পড়ছে।
দেয়ালের ইটগুলো দেখলে মনে হয় বুড়ো মানুষের ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের মত সুচালো হয়ে আছে। ভবনগুলোর ছাঁদে, দেয়ালে দেয়ালে পরগাছা বৃক্ষের চারাগুলো তরতর করে গগণ ছুঁয়ে দেখার মিনতি দেখাচ্ছে। ভবনের জীর্ণ শীর্ণ নাজুক অবস্থা দেখে অনূভুত হলো আপন জনের প্রতি দূরত্বটা বেড়ে গেলে দূরের লোকগুলো উড়ে এসে জুড়ে বসতে চায়। দেয়ালে শুধু ইটের কারুকাজ দেখে বিস্মিত না হয়ে পার পাওয়ার জো নেই। ভেতরে ঘুটঘুটে নিকচ কালো অন্ধকার! সন্ধ্যে হলেই ভূতের আনাগোনা নিশ্চিত বেড়ে যায়। তারআগে আমি সেখানে শ্বেতপাথরে সুলতানি বাংলার অন্যতম রাজধানীর সম্পর্কে চলুন জেনে নেয়া যাক।
"হাজার বছরের প্রাচীন নগর সুবর্ণগ্রাম ছিল পূর্ব বাংলার অন্যতম রাজধানী ও নদীবন্দর। আজকের সোনারগাঁ প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। এই সুবর্ণগ্রামেই তের শতকের স্থানীয় হিন্দু রাজা দনুজমাধব দশরথদেব তাঁর শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গ অঞ্চল মুসলিম শাসনে আসার পর থেকে ১৬১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত সোনারগাঁ ছিল স্বাধীন সুলতানী বাংলার অন্যতম রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র।
ঔপনিবেশিক সময়কালে ও এই এলাকায় বাণিজ্যিক, আবাসিক, ধর্মীয় কেন্দ্রিক স্থাপত্য কর্ম নির্মিত হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে ৩০ কি.মি. দক্ষিণ পূর্বে পানাম নগরের অবস্থান। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ধনাঢ্য হিন্দু বণিকদের দ্বারা পানাম নগরের গোড়া পত্তন ঘটে। পূর্ব দক্ষিণে বিস্তত প্রায় ৬০০ মিটার দীর্ঘ ও ৫ মিটার প্রশস্ত একটি সড়কের দুইপাশে সুরম্য মোট ৫২ টি ভবন নিয়ে পানাম নগর। ভবনগুলির অধিকাংশ আয়তাকার এবং উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত। উচ্চতা একতলা থেকে তিনতলা। স্থাপত্যশৈলীতে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সাথে মুঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া নির্মাণ শৈলীতে স্থানীয় কারিগরদের শিল্প কুশলতার প্রয়োগ ও ঘটেছে। বিভিন্ন পরিমাপের ইটের সঙ্গে চুন সুরকীর আস্তর দিয়ে নির্মিত ভবনসমূহে ব্যবহৃত হয়েছে মোজাইক, রঙিন কাঁচ, চিনিটিকরী, ছাদে কাঠের বীমবর্গা। চমৎকার স্টাকো অলংকরণে সমৃদ্ধ ভবনসমূহের দুইপাশে পরিবেষ্টিত পরিখা, ঘাটসহ পুকুর ও অনেকগু-ে কূপ রয়েছে।
ভবনসমূহের মধ্যে প্রাপ্ত লিপি অনুযায়ী কাশীনাথ ভবন (১৩০৫ বঙ্গাব্দে নির্মিত), নীহারিকা ভবন এর নামকরণ পাওয়া যায়। পানাম নগরীর পাশ্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে বড় সদারবাড়ি, ছোট সর্দারবাড়ি, পানামসেতু, গোয়ালদী মসজিদ, মঠ, পোদ্দারবাড়ি টাকশাল, গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের সমাধি উল্লেখযোগ্য" এই ছিল ভেতরের গোরের কথা। আমরা ২২ নং ভবনের সামনে আবারো কয়েকটা গ্রুপ ছবি নিলাম। ফোনের রেজুলেশন বাড়িয়ে দিলেও আকাশের উজ্জ্বলতা না থাকায় ছবিতে ঘোলাটে ঘোলাটে মনে হয়। গতকালও প্রকৃতির আবহাওয়া জ্বলজ্বল করছিল।
আজ সকাল থেকেই আকাশে ঘন কুয়াশায় সূর্যের আলোকে নিস্তেজ করে রেখেছে। প্রকৃতির এমন উদাসীনতা আমাকে খুব বেশি বিরক্তির মধ্যে ফেলে দেয়নি কারণ শীতের হিম শীতল বাতাস না থাকায় সকলকে নিয়ে গেছে এক প্রফুল্লতার চাদরে। তিনজন,চারজন মিলেমিশে একগুচ্ছ ফুলের বাসনের মত মিষ্টি কথার মৌ মৌ গন্ধ ছড়াচ্ছে চারপাশে। অনুভূত হয়, কিন্তু কেউ কারোর মুখপানে তাকানোর সময় নেই। অস্থায়ী একটা সম্পর্ক এত দ্রুত ঘনিষ্ঠের দিকে ধাবিত হবে, যাহা কল্পনার বহির্ভূত। এদিকে সহপাঠী রাসেল ভাই,জাকিরুল ভাই, লিখন দাস ও আমি সহ সিগারেট টানার ঘোর একটা নেশায় ভবনগুলোর আশেপাশে চিপা জায়গা খুঁজছি। অবশেষে লেইকের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা হুক্কা টানার মত তিনজনে তিনটা বেনসন টেনে শেষ করে আবার স্যারদের গ্রুপে যোগ দেই। আমরা তামিম ভাই,জাহাঙ্গীর ভাই,বেলাল ভাইদের সাথে জীবনের খুটিনাটি বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে করতে একপর্যায়ে ভবনগুলোর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম, সেখানে দেখা গেলো রাস্তার উপর লোহার গেইট দিয়ে ভবনগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছেন। নিরাপত্তার দিক থেকেও যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। একশ গজ পরপর আনসার বাহিনী রয়েছে।
আমরা আবারো চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। বৃদ্ধ একজন চাচা চা,পান,সিগারেট বিক্রি করছেন দেধার্ছে।
একটাবিষয় যথেষ্ট কৌতূহল মনে হলো, গেইটের একপাশে দোকানদার ও আরেক পাশে ক্রেতা বা পর্যটকদের ভীর। চা শেষ করে আবার হাঁটা শুরু করলাম, হাঁটতে হাঁটতে কাশিনাথ ভবনের সামনে এসে ছবি পাগল রিয়াদ ভাই ও তামিম ভাই সিঙ্গেল কিছু পোজ দিলেন। এভাবে আমরা হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে সবাই বেরিয়ে এসে হস্তশিল্পের বাজারে প্রবেশ করে এটা-সেটা কেনা হলো, আমিই বা বাকি থাকবো কেন? আমার বৌয়ের জন্য আমিও কিনলাম খোঁপায় গুঁজে রাখা বাঁশের কাঠি। তারপর আবার সোজা বাসের সীটে বসে গেলাম। ক্লান্ত শ্রান্ত নিথর শরীরটা বাসের সীটে এলিয়ে দিয়ে স্বস্তি পেলাম।
চাকুরির সুবাদে হয়তো কখনোই এভাবে হাঁটাচলা করা হয়না। আজ একটু শরীরটার ওপর ধকলটা বেশি পড়েছে মনে হচ্ছে। বাস আবার যাত্রা শুরু করলো জয়নাল আবেদিন যাদুঘরের দিকে। দুই কিলোমিটার যেতেই পৌঁছে গেলাম। আমাদের শিক্ষক কামরুল স্যার ইউনিভার্সিটির পাস নিয়ে যাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করে সকল শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের অনুমোদন নিয়ে সবাইকে ভেতরে প্রবেশ করানো হলো। আমরা সকলে ভেতরে প্রবেশ করেই মনে হলো যেন কূয়োর ব্যঙ সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে। সবাই দ্বিকবিদিক ঘুরছে আর ছবি তুলছে। মূল ফটক ছাড়াতেই প্রথমে চোখে পড়লো গরুরগাড়ির ভাস্কর্য।
সেখানে গ্রুপ ছবি নিয়ে সবাই এগিয়ে গেলো যাদুঘরের দিকে। ভেতরে রয়েছে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ব্রিটিশদের ব্যবহৃত নানা রকম হস্তশিল্পের আসবাবপত্র ও দেয়ালে টাঙানো জয়নাল আবেদিনের হাতে আঁকা অসংখ্য ছবি ও গ্রামীণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। সিঁড়ির পাশে দেয়ালে বৃহদাকারে টাঙানো আছে নকশিকাঁথা, এককথায় মনোমুগ্ধকর একটা নান্দনিক দৃশ্য। আমরা রীতিমতো প্রথম তলা, দ্বিতীয় তলা,তৃতীয় তলা পরিদর্শণ করে বেরিয়ে এসে সোজা লেইকের পদ্মফুল দেখার এক অমোঘ নেশায় চলে গেলাম উত্তরের দিকে। সেখানে রয়েছে নানা রকম নাগরদোলা, আরও রয়েছে বাঁশ ও কাঠের তৈরি নানা রঙের শো- পিচ এর দোকান। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে সময় ঘনিয়ে আসে। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি ছড়িয়ে দেয়, পল্লী কবি জসিমউদদীনের অমর কবিতা কবর কবিতার শেষ দুই চরণের ধ্বনি প্রকৃতির খেয়ালে আপনা আপনিই হৃদয়ের কার্ণিশে বেজে ওঠে ----
" ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে
ওমনি করিয়া লুটাইয়া পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে "
বেলা শেষে পুরো টিম একত্রে বসে দূর্বাঘাসের উপর মাদুর বিছিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার জন্য বাসের হউসেল বেজে উঠলো। এযেন আরেক আনন্দঘন মুহুর্তে বেদনার করুণ সুর বেজে উঠলো, আনমনে বলতে ইচ্ছে করছে যেতে নাহি দেবো হায়, তবুও যেতে দিতে হয়।
একেকজন শিক্ষার্থী বকুলের ফুল হয়ে একই সুতোয় গেঁথে মাল্য হয়ে সুবাস ছড়িয়েছিলো লোক ও কারুশিল্প জয়নাল আবেদিন যাদুঘরের আঙ্গিনায়। বাস্তবতার এক তান্ডবলিলা কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন ছিন্নভিন্ন করে দিবে। দিবেইতো কেউ তো কারোর রক্তের সম্পর্কে আটকানো নয়, অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে সমুদ্রের সফেনের মত ঢেউয়ের পীড়াপীড়িতে আছড়ে পড়েছিল তটিণী-র তীরে। ফাগুনের পলাশ,হিজল,তমাল,শিমুলের মতো নানা রঙের ছড়াছড়িতে রাঙিয়ে দিয়েছিলো পুরো প্রকৃতি জুড়ে।
আবার যেন গ্রীষ্মের ভর দুপুরে সকলের আনন্দ অনূভুতি রোদে শুকিয়ে মিলিয়ে গেলো বসন্তের মহা উৎসব। মিলিয়ে গেছে তাতে কি, আবার যেন ফিরে আসে ঝড়ে যাওয়া বৃক্ষের পাতার মত নতুন পল্লব নিয়ে সকলের মাঝে। সময় হয়তো ফুরিয়ে গেছে, আনন্দ হয়তো মিলিয়ে গেছে, স্বপ্ন আর অনূভুতি কখনই ম্লান হয়না, নতুন কুঁড়ির মত শুভাগমনের প্রত্যশায় যাত্রাবাড়ির মহা ব্যাস্ত সড়কের আইল্যান্ডের সাথে গা ঘেঁষে সহস্র যানবাহন পেছনে ফেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লগো বিশিষ্ট দূরপাল্লার বাস শোঁ-শোঁ করে ক্যাম্পাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তেই ফিরলাম প্রিয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। এই ভ্রমনটি স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন। লেখক-শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।