কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেও চলছে পরিবর্তনের খেলা
নিজস্ব প্রতিবেদক
এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে পড়ালেখা করে চাকরিতে আসা কর্মকর্তাদের ডিএইতে যে নিয়ন্ত্রণ ছিল, তা শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মকর্তাদের হাতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) অন্তত ৩৪ জন কর্মকর্তার বদলি বা নতুন পদায়নের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়; যেখানে মহাপরিচালক থেকে শুরু করে বদলেছে সবগুলো উইংয়ের পরিচালক।
বেশ কয়েকটি প্রকল্পের পরিচালকসহ আরও শতাধিক কর্মকর্তার দপ্তর বদলের ফাইল কৃষি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে বলেও জানা গেছে।
এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে পড়ালেখা করে চাকরিতে আসা কর্মকর্তাদের ডিএইতে যে নিয়ন্ত্রণ ছিল, তা শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মকর্তাদের হাতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও ডিএই-এর কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগের শাসনামলে খামারবাড়িতে আধিপত্য বিস্তার করে নিজেদের গ্রুপের কর্মকর্তাদের ভালো জায়গায় পদায়ন, বদলি বা প্রকল্পের কর্মকর্তা নিয়োগে প্রভাব রেখেছেন বাকৃবি থেকে আসা কর্মকর্তারা। এ সময় অনেক যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্য কর্মকর্তাদের আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পদায়নের অভিযোগও রয়েছে।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, খামারবাড়ির কৃষি কর্মকর্তাদের অলিখিত দুটো গ্রুপ—যার একটি বাকৃবির এবং অন্যটি শেকৃবির—এই গ্রুপ দুটোর আরও মেরুকরণ হয় সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের সময়ে। কারণ তিনি ছিলেন বাকৃবির ছাত্র। ফলে তাদের গ্রুপটি ভালো পদায়নসহ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের শীর্ষে ছিল।
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আব্দুর রাজ্জাক কৃষিমন্ত্রী থাকার সময়ে বাকৃবি কেন্দ্রিক দুই গ্রুপের দাপট ছিল। এর একটিতে নেতৃত্ব দিতেন পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ বনি আমিন এবং কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোখলেছুর রহমান।
তাদের সঙ্গে ছিলেন অর্থ ও প্রশাসনের পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন—যাকে গত ২ সেপ্টেম্বরে গাজীপুরের বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে বদলি করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রশাসন উইং এ উপপরিচালক থাকাকালীন পরিচালক নিয়োগ দিতে দেননি নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং তাকে সহায়তা করতেন একই উইং এর উপপরিচালক মুহাম্মদ আবদুল হাই (বর্তমানে নরসিংদিতে বদলি)-সহ আরও অনেক কর্মকর্তা।
ডিএই-র কর্মকর্তাদের গ্রুপটি আওয়ামী লীগের পরিচয়েই নিজেদের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়ন বা বড় প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগে প্রভাব বিস্তার করতেন এবং এসব পদায়নের পেছনে অর্থ লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে। এজন্য তারা মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে সখ্য রেখে চলতেন।
ডিএই-র সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, বিসিএস (কৃষি) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোয়াজ্জেম হোসেন নেতৃত্বে সক্রিয় ছিলেন দ্বিতীয় আরেক গ্রুপের। এরাও টেন্ডার থেকে শুরু করে পদায়ন-বদলির বিষয়ে প্রভাব রাখতেন। হামিদুর রহমান এখনো একটি প্রকল্পে মোটা বেতনে কনসালটেন্ট হিসেবে চাকরিরত আছেন।
ডিএই এর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের দুটি গ্রুপের উপরই প্রভাব রাখতেন কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (কেআইবি) মহাসচিব কৃষিবিদ মো. খায়রুল আলম (প্রিন্স); সঙ্গে থাকতেন আওয়ামীপন্থী কমিটির সদস্যসহ সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কৃষি পরিষদের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, মহাসচিব এএফএম বাহাউদ্দিন নাসিম ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কৃষিবিদ মশিউর রহমান হুমায়ূন। তারই ডিএই-কেন্দ্রিক গ্রুপগুলো আর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এর সঙ্গে ছিলেন কৃষক লীগের নেতারাও।
কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হলে আব্দুর রাজ্জাকের জায়গায় প্রভাব বাড়তে থাকেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ওয়াহিদা আক্তার—যিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ সুপারিশে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন; যদিও এই নিয়োগ বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
মোহাম্মদ বনি আমিন ও মোখলেছুর রহমানের যে গ্রুপটি এক সময় আব্দুর রাজ্জাককে তোয়াজ করে চলতেন, তারাই সুযোগ বুঝে ওয়াহিদা আক্তারের সঙ্গে সখ্য বাড়ান। যেখানে জানুয়ারির নির্বাচনের পর আব্দুস শহীদ কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেও সচিবের মতামতই প্রাধান্য পেত।
সাবেক এই সচিব ছাত্র আন্দোলনে কর্মকর্তাদের নিয়ে ছাত্রদের বিপক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৪ আগস্ট ওয়াহিদা আক্তারের নেতৃত্বে ডিএই এর ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আহসানুল বাশার, সাবেক ডিজি বাদল চন্দ্র বিশ্বাস, প্রশাসনের সাবেক পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন ও উপপরিচালক মো. আব্দুল হাই (পার্সোনেল), উপপরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম (লিগাল ও সাপোর্ট), এআইএস পরিচালক সুরজিত শাহ রায় সহ অনেক কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ করেন।
আহসানুল বাশারকে সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডিঙ্গিয়ে ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দিয়েছিলেন সাবেক সচিব।
ওয়াহিদা আক্তারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি নানান অনিয়মের অভিযোগ ছিল। প্রভাব খাটিয়ে তিনি বার্ক-এর [বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল] সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ারের (এই সচিবের স্বামী) চুক্তির মেয়াদ দুই দফা বাড়ান।
ডিএই-এর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ফান্ডেড ৭,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ের পার্টনার প্রকল্পে যোগ্যতা না থাকার পরও প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসেবে মিজানুর রহমান ও এপিসি হিসেবে ড. গৌর গোবিন্দকে নিয়োগ দেন ওয়াহিদা আক্তার। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সাবেক সচিব ওয়াহিদা আক্তারসহ বাকৃবি গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে টিবিএস। তবে একজন বাদে কেউই বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, "সরকারের চাকরি করি, যেখানে বদলি করবে সেখানেই যেতে হবে। এর বাইরে কোনো মন্তব্য নেই।"
ডিএই-এর সিনিয়র হিসেবে মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. তাজুল ইসলাম পাটোয়ারীকে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও আর্থিক বিভাগের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ড. মো. শাহীনুল ইসলামকে।
এখন যে পদোন্নতি, পদায়ন হচ্ছে তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোহাম্মদ মাহবুবুর রশিদ। তিনি প্রশাসনের উপপরিচালক হিসেবে নতুন পদায়ন পেয়েছেন ১৯ আগস্ট। তিনি আগে নরসিংদীর জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
মাহবুবুর রশিদ ছাত্র অবস্থায় শেকৃবির ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। তার সঙ্গে রয়েছেন কৃষিবিদ মো. রেজাউল ইসলাম। যিনি এখনো হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক পদে চাকরিরত।
কৃষিবিদ রেজাউল ইসলাম চাকরিজীবনে ডিপার্টমেন্টাল শাস্তির কারণে পদোন্নতি হারিয়েছেন। তিনি বিসিএস ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা, যে ব্যাচের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে এখন ৪র্থ গ্রেডে থাকলেও রেজাউল ইসলাম আছেন ৬ষ্ঠ গ্রেডে। তিনি এখন বড় প্রকল্পের পিডি হওয়ার জন্য তদবির করে যাচ্ছেন।
রেজাউল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমরা শতাধিক কর্মকর্তার বদলি চেয়েছি ডিএই-এর কাজে গতি ও সংস্কারের জন্য। এটা হচ্ছে, কিন্তু খুব ধীরে ধীরে। আমি একটা প্রজেক্টে যাব, সেই প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে গেছে।"
সরকার পতনের পর মাহবুব রশীদ, রেজাউল ইসলাম, সম্প্রতি প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া শাহীনুল ইসলামসহ প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা ডিএইতে প্রেস কনফারেন্স করে তাদের বঞ্চিত হওয়ার দাবিদাওয়ার কথা তুলে ধরেছিলেন। ডিএই-এর পদোন্নতি, নতুন পদায়ন, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠাচ্ছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া টিবিএসকে বলেন, "কৃষির বিভিন্ন দপ্তরে যে অস্থিরতা শুরুতে ছিল তা এখন নিয়ন্ত্রণে। বঞ্চিতদের দাবি-দাওয়া থাকলেও সেটা যাচাই বাছাই করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।"
ডিএই-এর পাশাপাশি কেআইবি নিয়ন্ত্রণে এখন বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম ও এগ্রিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (অ্যাব) আহ্বায়ক রাশিদুল হাসান হারুনের গ্রুপ। ২০০৮ সালে অ্যাবের আহ্বায়ক ছিলেন আনোয়ারুন নবী মজুমদার বাবলা; তিনিও এখন কেআইবির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া।