ডার্ক মোড
Saturday, 27 July 2024
ePaper   
Logo
কবি জীবনানন্দ দাশ ও কবি আসাদ চৌধুরী স্মরণে

কবি জীবনানন্দ দাশ ও কবি আসাদ চৌধুরী স্মরণে

এস এম মোজাম্মেল হক

কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সংক্ষিপ্ত কর্মঃ

অক্টোবর বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য ও খ্যাতিমান দু’জন কবি’র জীবনাবসানের মাস।কাকতালিয়ভাবে উভয়ই বরিশালের সন্তান এবং একই মাসে তাদের জীবনাবসান ঘটে। জীবনানন্দ দাশ ৬৯ বছর পূর্বে পরলোক গমন করলেও আসাদ চৌধুরী খুব অল্প দিন পূর্বে ইন্তেকাল করেন।কবি ও লেখক হিসেবে উভয়েই বর্নাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন।আসাদ চৌধুরী সাহেবের সাথে আমার ব্যক্তিগত বেশ কিছু স্মৃতি রয়েছে।জাতীয় কবিতা পরিষদের মঞ্চে ও মঞ্চের বাইরে সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক ব্যক্তিগত আলাপ চারিতা হয়েছে বেশ কয়েকবার।তিনি ছিলেন অত্যন্ত হাস্যোজ্জল সহজ সরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।উভয়ের স্মরণে পর্যায়ক্রমে তাদের বর্নাঢ্য সাহিত্য জীবনের উপর নিম্নে আলোকপাত করা হলো।

জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে বাংলাদেশ) অন্তর্গত বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন৷ এবং ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪ সালে পরলোক গমন করেন সে হিসেবে তিনি প্রায় সারে ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন।চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তিনি দিনাতিপাত করেছেন৷ তার পূর্বপুরুষগণ বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর(বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) পরগণার কুমারভোগ নামক স্থানে “গাওপারা” গ্রামের নিবাসী ছিলেন যা বর্তমানে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে৷ স্থানটি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় অবস্থিত৷ তার পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে স্থানান্তরিত হন৷ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন৷ তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তার মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন৷জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র৷ সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক৷

জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিণী, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতেন৷ তার সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও শিশুশ্রেণির পাঠ্য৷ জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান; তার ডাকনাম ছিল মিলু৷ তার ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন৷ পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন বলেবাড়িতে মায়ের কাছেই জীবনানন্দের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত৷ ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনতেন৷ লাজুক স্বভাবের হলেও মিলুর খেলাধুলা, বাগান করা,ভ্রমণ ও সাঁতারের অভ্যাস ছিল।ছেলেবেলায় মামার সঙ্গে বহু জায়গায় বেড়িয়েছেন।শৈশবে একবার কঠিন অসুখে পড়েন৷ স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে মাতা ও মাতামহ হাসির গানের কবি চন্দ্রনাথের সাথে লক্ষ্মৌ,আগ্রা,দিল্লী প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেন৷ জন্মসূত্রে তার পদবি "দাশগুপ্ত" হলেও তিরিশের দশকের শুরুতে জীবনানন্দ "গুপ্ত" বর্জন করে কেবল দাশ লেখা শুরু করেন৷

জীবনানন্দ দাশ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক৷ তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম।তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে৷ জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল, ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হন।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, ফলে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন৷ বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ অন্যদিকে,অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন।সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন ।জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে ১৯৫৩ সালে পুরস্কৃত হয়৷ ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি৷ জীবনানন্দ দাশ প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন৷ তবে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি৷

কবি আসাদ চৌধুরীর জীবন ও সংক্ষিপ্ত কর্মঃ

বি আসাদ চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।তার বাবার নাম মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী এবং মায়ের নাম সৈয়দা মাহমুদা বেগম।

কবি আসাদ চৌধুরী ১৯৫৭ সালে আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯৬০ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হবার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।আসাদ চৌধুরী একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আবৃত্তিকার।বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কবি আসাদ চৌধুরী আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। বাংলাসাহিত্যে স্বতন্ত্র কাব্য ভাষা তৈরি করে নিজস্বতা অর্জন করতে সক্ষম হন।শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে।আসাদ চৌধুরীর সাহিত্য সম্ভার সব ধরনের মানুষের পছন্দ।

তার লেখায় তথ্য ও ভাবনার রসদ পান সব বয়সের পাঠক।সাহিত্যে তিনি গণমুখী,নান্দনিক ও রোমান্টিক ধারা বজায় রেখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন সবই তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি আসাদ চৌধুরীর প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’-এ ব্যপক পরিচিতি পান। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন।কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে কবি আসাদ চৌধুরী মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন।তার বাচনভঙ্গি, টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও উপস্থাপনার জন্যও তিনি সর্ব মহলে পরিচিত পান।মৌলিক কবিতা ছাড়াও তিনি শিশুতোষ গ্রন্থ,ছড়া,জীবনী ও অনুবাদ করেছেন।

বাংলাসাহিত্যে তাঁর সৃষ্টি ও কাজের ব্যাপ্তি সংক্ষেপে বোঝানো সহজ নয়।তবে তাঁর কবিতা বা প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমেই মননের গভীরতা যে কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত।তিনি কবি আল মাহমুদ পরিষদের সভাপতি ছিলেন। বাংলাসাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয় কবি কালের সীমা অতিক্রম করে তিনি হয়েছেন কালোত্তীর্ণ ।কবি ৮০ বছর বয়সে ২০২৩সালের ৫ অক্টোবর তারিখ কানাডার টরোন্টোতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।আমরা তার বিদেহী আত্মার পরকালীন শান্তি কামনা করছি।

১৯৮৩ সালে তাঁর রচিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।এ ছাড়া একই বছর তিনি সম্পাদনা করেন বঙ্গবন্ধুর জীবনী ভিত্তিক গ্রন্থ ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু।’ তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন