
ঐতিহাসিক বঙ্গ ভঙ্গ ও ৪৭ এর দেশ বিভাগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গে
প্রফেসর মোঃ এনামুল হক খোন্দকার
১৯০৫ সাল, ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সংস্কার পূর্বক শাসন কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে সুবিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে ভেঙ্গে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি নূতন প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার সমগ্র ভারত উপমহাদেশকে মাত্র তিনটি প্রশাসনিক ইউনিট তথা প্রেসিডেন্সিতে বিভক্ত করে শাসন কার্যক্রম চালাত। এগুলো হলো, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি,মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ও বোম্বে প্রেসিডেন্সি। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গঠিত হয়েছিল বাংলা, বিহার,উরিষ্যা, আসাম ও ত্রিপুরার এক সুবিশাল অঞ্চল নিয়ে। রাজধানী কোলকাতা থেকে তদানীন্তন অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে একজন ছোট লাট বা গভর্নরের অধীনে এ সুবিশাল অঞ্চল শাসন করা কালক্রমে দূরহ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে অসংখ্য খাল বিল নদ নদী ও পাহাড় পর্বত বিশিষ্ট জটিল ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পূর্ব বাংলা ও আসাম এর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের প্রত্যাশিত উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা সুদূর রাজধানী কোলকাতা থেকে প্রায় অসম্ভব ছিল। এমতাবস্থায় বড় লাট সাহেব উক্ত বৃহৎ প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করার যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।বর্তমান স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশদের তৈরি এ তিনটি প্রেসিডেন্সিকে ভেঙ্গে আটাশটি রাজ্য বা প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।
ইতোপূর্বে তদানীন্তন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ব বঙ্গের মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ তখনকার সময়ে পশ্চিম বঙ্গের হিন্টারল্যান্ড বা পশ্চাদভূমি হিসেবে পরিচিত পূর্ব বাংলার মাটি ও মানুষের উন্নয়নে ব্রিটিশদের তৈরি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের সমন্বয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম প্রধান প্রদেশ গঠনের দাবি তুলেন।বড় লাট লর্ড কার্জন মুসলমানদের প্রতিনিধি নবাব সলিমুল্লাহর যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম প্রধান প্রদেশ পূর্ব বঙ্গ ও আসাম সৃষ্টি করেন। এপ্রদেশ গঠনের ফলে পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগন একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। ১৬১০ সালে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবেদার ইসলাম খানের প্রতিষ্ঠিত রাজধানী ঢাকা কয়েক শতক পর আবারও তার হারানো গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পায়। এতে শুরু হয় শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও অবকাঠামোগত অভূতপূর্ব উন্নয়ন। শুধু নূতন প্রদেশের রাজধানী ঢাকাতেই নয়, সমগ্র প্রদেশব্যাপী উন্নয়নের দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকে।
আর তখনি উতলে উঠে কলকাতার বাঙালি বাবুদের নীতিভ্রষ্ট বর্ণবৈষম্য ভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা।তারা প্রবল বিরোধিতা শুরু করে নবসৃষ্ট এ প্রদেশের। পশ্চিম বঙ্গ ভিত্তিক অখন্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে নূতন প্রদেশ পূর্ব বঙ্গের বিরোধীতার পেছনে ঐ সকল বাঙালি বাবুদের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার লোকদের কায়েমি স্বার্থের বিঘ্ন ঘটার বিপজ্জনক ভবিষ্যত সম্ভাবনা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল।যেমন কোলকাতার জমিদার বাবুরা আশংকা করছিল, নূতন প্রদেশ সৃষ্টির ফলে পূর্ব বঙ্গে তাদের জমিদারি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। উকিল বাবুরা মনে করল,ঢাকায় যদি হাইকোর্ট গড়ে উঠে, তাহলে পূর্ব বাংলা থেকে তাদের মক্কেল আমদানি হ্রাস পাবে।
এতে তাদের দৈনন্দিন রোজগারে ভাটা পড়বে। পন্ডিত বাবুরা ভাবল, ঢাকায় পর্যাপ্ত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলে পূর্ব বাংলার চাষাভুষার ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে তাদের একচেটিয়া প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব ক্ষুন্ন হবে। অনুরুপ লিখক ও সাংবাদিক বাবুরা চিন্তা করলো, পূর্ব বাংলায় মুসলিম জাগরণ হলে, তরুণরা শিক্ষিত হলে তাদেরও কপাল পুড়তে পারে। তাই এসব কায়েমি স্বার্থবাদী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী এতকাল ধরে যারা পূর্ব বাংলার পাট নিয়ে পশ্চিম বাংলায় পাটকল গড়ে তুলেছিল, পূর্ব বাংলার ধান চাল যাদের এতকাল ব্যাপী অন্ন যুগিয় আসছিল, পূর্ব বাংলার মানুষকে যারা শিক্ষা স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছিল, তারা সবাই মেকি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে নবসৃষ্ট প্রদেশকে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ হিসেবে আখ্যায়িত করে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনকি অভিজাত বাঙালি বাবুদের প্ররোচনায় তাদের যুব ও তরুণ সমাজ ব্রিটিশ বিরোধী সর্বাত্মক সহিংস কর্মতৎপরতা চালাতে শুরু করে। তখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও কোলকাতার বাবুদের নগ্ন সাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে সমর্থন দান করে। ফলে পূর্ব বাংলা সহ উপমহাদেশের মুসলমানরা ধীরে ধীরে কংগ্রেস থেকে মূখ ফিরিয়ে নেয় এবং ভারতীয় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ ও অধিকার সচেতন করে তুলতে মুসলমানদের জন্য একটি নিজস্ব রাজনৈতিক প্লাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
নবাব সলিমুল্লাহ সহ তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবৃন্দ পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া ভাগ্যবিড়ম্বিত মুসলমান জনগোষ্ঠীর উন্নতিকল্পে নূতন প্রদেশটিকে টিকিয়ে রাখতে ব্রিটিশ সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা ও সমর্থন প্রদান করেন এবং নিজেরাও এ প্রদেশের ক্রমোন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অপরদিকে নবসৃষ্ট প্রদেশটিকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে হত্যার জন্য পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু কবি, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে শীর্ষ কংগ্রেস নেতৃত্ব প্রচন্ড প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কোলকাতা কেন্দ্রিক অগ্রসর হিন্দু সমাজ ও যুবকশ্রেণীর সর্বগ্রাসী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ফলে শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সবচেয়ে বেশি মানসিকভাবে আহত ও বিপর্যস্ত হন পূর্ব বাংলার জনগনের অভিভাবক ও অকৃত্রিম বন্ধু নবাব সলিমুল্লাহ। এতে তিনি এতটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন যে, এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পূর্ব বাংলাকে কেন্দ্র করে তার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যাওয়ায় এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে উপমহাদেশের রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং এর কয়েকবছর পর ১৯১৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
নূতন প্রদেশ বাতিলের প্রেক্ষিতে নবাব সলিমুল্লাহ সহ মুসলমান নেতৃবৃন্দের অন্তরের ব্যাথা খানিকটা উপসম করতে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ক্ষতিপূরণ স্বরুপ ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর দীর্ঘদিনের দাবিকৃত ও তাঁর দানকৃত জমির উপর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। এতেও কোলকাতা কেন্দ্রিক সেই সাম্প্রদায়িক শক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধীতায় আটঘাট বেঁধে নেমেছিল। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা মক্কা ইউনিভার্সিটি হিসেবে উপহাস করে নানাবিধ তীর্যক মন্তব্য করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তারা এক অপমানজনক প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছিল, পূর্ববাংলার চাষাভুষার ছেলেমেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কী প্রয়োজন থাকতে পারে।
অবশেষে সব বাঁধার বিন্ধাচল পেরিয়ে নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁরই সুযোগ্য সহযোদ্ধা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও বরিশালের শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের অদম্য প্রচেষ্টা ও অব্যাহত সংগ্রামের ফলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব পদযাত্রা শুরু হয়।
১৯০৫ থেকে ১৯৪৭, ততদিনে পদ্মা,মেঘনা,গঙ্গা,যমুনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। বাংলায় হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানরাও ধীরে ধীরে শিক্ষিত ও রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠে।অবিভক্ত বাংলায় জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদে ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব অর্জন করে। ফলে যুক্ত বাংলায় ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত শেরেবাংলা একে ফজলুল হক,খাজা নাজিমুদ্দিন ও শহিদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পর্যায়ক্রমে মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয় এবং সরকার পরিচালিত হয়। বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় ভিনদেশী ইংরেজের শাসন মনে প্রাণে মেনে নিতে পারলেও শেরে বাংলা, নাজিমুদ্দিন ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিত্বমূলক মুসলিম শাসনকে তারা কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারেনি। দিন দিন তারা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে ভয়ানক রুপে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
এরই ফলশ্রুতিতে কোলকাতা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘঠিত হতে থাকে। সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল ১৯৪৬ এর কোলকাতা দাঙ্গা, যে দাঙ্গায় উভয় সম্প্রদায়ের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়,এ দাঙ্গার জন্য মুসলমানরা দায়ী ছিলনা। উগ্র হিন্দুদের পক্ষ থেকে দাঙ্গা বাঁধাতে উস্কানি দেয়া হয়েছিল এবং ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘঠিত হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ইস্যু সামনে আসলে বাংলার মুসলমানরা পূর্ব ও পশ্চিম অবিভক্ত বাংলাকে স্বাধীন সার্বভৌম রাখার পক্ষে মত দিয়েছিল এবং এ বিষয়ে বহু দেনদরবার করেছিল। হিন্দু নেতাদের মধ্য থেকে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের বড়ভাই শরৎচন্দ্র বোস,কিরন সংকর রায় প্রমুখ উদার হিন্দু কংগ্রেস নেতা যুক্ত বাংলাকে স্বাধীন রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন এবং এ লক্ষ্যে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। এমনকি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রদূত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেবও অবিভক্ত বাংলা যদি ভারত ও পাকিস্তান কোনো ডোমিনিয়নে যোগ না দিয়ে পৃথক ও স্বাধীন থাকতে চায়, এতে তাঁর আপত্তি নেই মর্মে মত প্রকাশ করেছেন।
তিনি তাঁর এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, প্রকৃত পক্ষে কোলকাতা ছাড়া পৃথক বাংলার কোনো গুরুত্ব নেই। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও উগ্র সাম্প্রদায়িক বাঙালি হিন্দু নেতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে উভয় বাংলাকে স্বাধীন সার্বভৌম রাখার মিশন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা আর সম্ভব হয়নি। পরিশেষে অনেকটা নিরুপায় হয়ে বাংলার মুসলমানদেরকে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে মিলিত হয়ে পাকিস্তানে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল। পূর্ব বাংলা তদানীন্তন সময়ে সবদিক থেকে অনুন্নত ও পশ্চাদপদ হওয়ায় তখনকার বাস্তবতায় পৃথক ও স্বাধীন থাকা অনেকটা অসম্ভব বিবেচিত হওয়ায় বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ সে পথে হাঁটার চেষ্টা করেননি মর্মে প্রতীয়মান হয়। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো,১৯০৫ সালে যে হিন্দু সমাজ বাংলা ভাগকে বাংলা মায়ের অঙ্গছেদন বলে মাতম করেছিল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গ ভঙ্গের প্রতিবাদে "আমার সোনার বাংলা"গান রচনা করেছিলেন, সাতচল্লিশে এসে সেই বাংলাকে ভাগ করার জন্য তারা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়লো।এর কারণ হিসেবে বলা যায়, হিন্দু প্রধান পশ্চিম বঙ্গে ও মুসলিম প্রধান পূর্ব বঙ্গে গড় জনসংখ্যার হারে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রায় ৫৬% মুসলিম ও ৪৪% হিন্দু। সুতরাং স্বভাবতই অবিভক্ত বাংলা স্বাধীন হলে এটা হবে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র তথা মুসলিম রাষ্ট্র। গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসনকার্য পরিচালিত হলে এদেশ শাসিত হবে মুসলমানদের দ্বারা,যা কোনোভাবেই হিন্দু জনসাধারণ মেনে নিতে পারে না। অতএব তারা তাদের ১৯০৫ সালের মেকি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিসর্জন দিয়ে অখন্ড ভারতীয় জাতীয়তার মধ্যে নিজেদের লীন করে দেয়।
আর আমরা পূর্ব বাংলার মুসলমানরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম পরিচয়ে হাজার মাইলের ভৌগলিক দূরত্বে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে প্রায় চব্বিশ বছর একসঙ্গে থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চরম বৈষম্যের শিকার হয়ে ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিয়তার ভিত্তিতে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত "আমার সোনার বাংলা"গানটি। যে গানের মূল স্পিরিট হলো, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিয়তার ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার সমন্বয়ে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা বা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন।
১৯৪৭ সালেও আমরা বাঙালি মুসলমানরা উল্লিখিত জাতীয়তাবাদী চেতনা লালন করেছিলাম,যা উগ্র বর্ণহিন্দুত্বের কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এই চেতনার ভিত্তিতে ১৯৭১ এ আমরা পাকিস্তানের কবল থেকে মূক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা ও দাবি হলো, আমাদের আশেপাশের বাংলা ভাষা ভাষী অঞ্চলগুলোও একই জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে বৃহত্তর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকাতলে স্হান লাভ করুক। তবেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মূল স্পিরিটের পূর্ণতা লাভ করবে। অখড বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ধারণকারী " আমার সোনার বাংলা" এ গানটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে এক সর্বাত্মক জনযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভকারী স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত, হিসেবে নির্বাচন অবশ্যই যথার্থ ও যৌক্তিক।
এ গানের কথায় আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো আপত্তিকর কিছু আছে বলে আমি মনে করিনা। যারা এমনটি মনে করে তা তাদের অজ্ঞতা ও গোঁড়ামিপূর্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে অহেতুক বিতর্ক ও এর পরিবর্তন দাবি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অন্যায্য এবং এটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের চিন্তা চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং এ নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করা কারও কাম্য হতে পারেনা। জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা এসব মিমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে নূতন করে বিতর্ক নিষ্প্রয়োজন।
অবার অনেকে বলে থাকেন, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা যেহেতু আমাদে দেশে জন্ম লাভ করা নাগরিক নয়, তাঁর রচিত গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারেনা। এ কথাটাও যৌক্তিক নয়। এর প্রতিউত্তরে বলা যায়, পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবালের কবিতা " ছারা জাঁহা ছে আচ্ছা হায় হিন্দুস্তাঁ হামারা", এ কবিতাটি এখনও সমগ্র ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা হিসেবে এর ব্যাপক চর্চা হয়। এ কবিতাটি কবি ইকবাল কর্তৃক রচিত হয়েছিল, যখন তিনি সর্বভারতীয় জাতীয়তার দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এ দর্শন থেকে সরে গিয়ে দ্বিজাতিতত্তের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চল নিয়ে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। স্বাধীন ভারতে ইকবালের এ কবিতাটি তারানায় কাওমিয়ার সমান মর্যাদা লাভ করে মর্মে জানা যায়।
আসলে বিজ্ঞানী,কবি, সাহিত্যিকরা পৃথিবীর যে দেশেই জন্ম গ্রহণ করুক না কেন, তাদের সৃষ্টি কর্ম নির্দিষ্ট কোনো দেশ কালের গন্ডিতে আবদ্ধ নয়। বরং তা সমগ্র মানবজাতির সম্পদ। তাছাড়া আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে রবীন্দ্র নজরুল সহ সকল বাঙালি কবি সাহিত্যিকের অবদান অনস্বীকার্য। এদের কাউকে বর্জন করা সম্ভব নয়।
লেখক, অধ্যক্ষ, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী