ডার্ক মোড
Friday, 18 October 2024
ePaper   
Logo
এলজিইডি'তে এখনো চলছে বাবুর রাজত্ব : কর্তৃপক্ষ নীরব

এলজিইডি'তে এখনো চলছে বাবুর রাজত্ব : কর্তৃপক্ষ নীরব

নিজিস্ব প্রতিবেদক

শহিদুল ইসলাম ওরফে হুজুর বাবু’র ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না এলজিইডির কেউ। এলজিইডির সাধারণ কর্মচারিদের প্রশ্ন, একজন ব্যক্তির অপরাধের দায় কেন নিচ্ছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। যে কিনা সরকারি চাকরিবিধি না মেনে ভূয়া প্রকল্পে চাকরি নিয়ে বছরের পর বছর বেতন ভাতা উত্তোলন করছে। এতে কি কোনো দায় নেই কর্তৃপক্ষের। কিভাবে সে চাকরিতে যোগদান করলো? তার শিক্ষাগত যোগ্যতাই বা কি? কোন কলেজ থেকে লেখাপড়া করেছে সে? কিভাবে সবার চোখের সামনে দিনের পর দিন সরকারি চাকরির সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে? একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে কিভাবে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে? কার ছত্রছায়ায় বাবু বেপরোয়া? এর দায় কি এড়াতে পারে কর্তৃপক্ষ? প্রশ্ন উঠেছে, এলজিইডি কর্তৃপক্ষ কি তাকে ভয় পায়? নাকি অন্য কোন স্বার্থসিদ্ধ কিছু লুকিয়ে আছে? যে কারণে বাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছে তারা।

দৈনিক সকালের সময়ের অনুসন্ধানে নিত্য নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বাবুর বিরুদ্ধে। একসময় অভাবের কারণে বাবা আবদুল মোতালেবের হাত ধরে শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় আসেন শহিদুল ইসলাম (হুজুর বাবু)। ঢাকায় এসে ঘাটি গাড়েন আগারগাঁও বিএনপি বস্তিতে। জানা গেছে, এই বস্তিতেই তার বেড়ে ওঠা। করতেন পাসপোর্ট অফিসের দালালি। এখন সে মস্ত বড় নেতা। তার ইশারায় অবৈধ কার্যকলাপ চলে এলজিইডিতে। লেবাসের আড়ালে সে এতটাই ভয়ংকর জানলে ভয়ে পিলে চমকাবে যে কারো।

সূত্র বলছে, বাবু সারাদিন পাঞ্জাবি টুপি পরা থাকলেও রাতে প্যান্টশার্ট পরে হাজির হয় শামীম সরণি এলাকায় তার গোপন আস্তানায়। সেখানে সে জুয়া ও মদের আসর বসায়। স্থানীয় কাউন্সিলর, মন্ত্রী নাকি তার পকেটে থাকে। অর্থাভাবে লেখা পড়া ঠিকমতো করতে না পারলেও এলজিইডির নিয়োগপত্রে দাখিল করেছে বিএ পাশের সার্টিফিকেট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সে তেমন লেখাপড়াই করেনি। এমনকি এসএসসির গন্ডিও পেরোয়নি বাবু। যে কারণে দপ্তরে কানাঘুষা হয় দেশে লেখাপড়া করা এতো বেকার যোগ্য যুবক থাকতে কিভাবে সে সরকারি চাকরিতে এখনও বহাল রয়েছে।

সূত্র বলছে, ২০১৩-১৪ সালে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানের আমলে প্রায় চার হাজার চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য আদালতে মামলা দাখিল করে। ঠিক সেই সুযোগে চতুর বাবু নিজের নামটি (এইচপিপিপি) নামক ভূয়া প্রকল্পে ১৮-১১-১৯৯৯ সালে হিসাব সহকারি হিসেবে নাম ঢুকিয়ে দপ্তরটিতে জায়গা করে নেন। অথচ এ ধরনের কোন প্রকল্পের অস্তিত্ব এ দপ্তরে কখনোই ছিল না। পরবর্তীতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত চাকরি স্থায়ীকরণের পক্ষে রিট মামলা/সিপি নং ৩৫৩৬/২০১০, সিপি নং-৬০২/২০১১ ক্রমিক নং-১২ রায় দিলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রামীণ সড়ক ও হাটবাজার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ২৩-১০-২০১২ তার নামটি স্থায়ী হয়। দেশের বেশির ভাগ সরকারি দপ্তরের তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কারণে বদনাম হচ্ছে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের। তারা রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে দপ্তরগুলোতে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারি আধিপত্য বিস্তার করেছে।

কেউ কেউ আবার একাধিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দলের নাম ভাঙিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে তটস্থ করে রেখেছে। অনেকেই আবার স্থানীয় মন্ত্রী এমপিদের সাথে ছবি তুলে সেই ছবি অফিসে বা বাসায় ঝুলিয়ে রেখে সাধারণ মানুষকে বুঝাতে চান মন্ত্রী এমপিদের সাথে তার চরম সম্পর্ক, তারে ছাড়া তাদের বাঁচা দায়। সে যদি তাদের রাজনীতি না করে তাহলে গদি বাঁচানোই সম্ভব না। ভাব-ভঙ্গিতেও এরা অনেক এগিয়ে। যে কারণে সাধারণ মানুষ তাদের কথায় আকৃষ্ট হয় খুব সহজে। চাকরি, বদলি, টেন্ডার পাইয়ে দেয়া তাদের কাছে কোন ব্যাপারই না।

এখানেই প্রতারিত হয় সাধারণ মানুষ। এভাবে ভুক্তভোগীদের অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন- এদের খপ্পরে পড়ে। কিছু কিছু দপ্তরে কোন ধরনের কর্মচারী ইউনিয়নের অফিস নেই অথবা অনুমতি নেই তারপরও তারা অত্র দপ্তরের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে দপ্তরগুলোতে একধরনের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাদেরই একজন এলজিইডির শহিদুল ইসলাম বাবু (হুজুর বাবু)। দৈনিক সকালের সময়’র অনুসন্ধানী টিম গিয়েছিল তার জাতীয় পরিচয়পত্রে দেওয়া নিজ গ্রামের ঠিকানায়, সেখানে গিয়ে স্থানীয় লোকজন ও জন প্রতিনিধি জাকির হোসেনের সাথে কথা হলে তারা কেউ তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। এমনকি মুক্তারের চর ইউপি চেয়ারম্যান বাদশা শেখও একই কথা বলেছেন। তারা বলেন, এ নামে আমরা কাউকে চিনি না। তারা বলেন, বাবু কেন এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিলো কর্তৃপক্ষের বিষয়টি যাচাই করা উচিত।

অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, শ্রেণী-তৃতীয়, গ্রেড-১৬ অনুযায়ী বাবু বেতন পায় সাকূল্যে ২৬২৭৬ টাকা। সরকারি নিয়ম ভেঙে ব্যবহার করছেন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি। আছে কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, নামে বেনামে জায়গা জমিসহ অনেক কিছু। চলনে-বলনে মনে হবে কোন রাজা বাদশা। প্রধান প্রকৌশলীসহ দপ্তরটির কর্মকর্তা কর্মচারীদের তার হুকুম ছাড়া নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই বলে জানা যায়। কেনই বা যাবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি তার ডান হাত। বাবুর কথার বাইরে নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক পা-ও সামনে এগোন না।

তিনি বলে বেড়ান ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাবু না থাকলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পাশ করার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। সাধারণ মানুষকে বোঝান, আপনারা ছবি দেখে বোঝেন না তার সাথে আমার কি সম্পর্ক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিইডির একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য সে অনেকের গায়ে হাতও তুলেছে। যে কারণে তার বিরুদ্ধে টুঁশব্দ করার সাহস পায় না কেউ। বাবু চাকরি করে নামেমাত্র কিন্তু তার মুল কাজ হলো বদলি, টেন্ডার বাণিজ্য। এমনকি অনেকের চাকরি স্থায়ী করণের কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না বা অভিযোগ দিচ্ছে না। জানা যায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা পরিচয় দিয়ে বিএনপি-জামায়ত ঘেষা এই কর্মচারী বছরের পর বছর আরসিসি ভবন (এলজিইডি) তে অফিসারদের মত এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছে।

সামান্য একজন কর্মচারী যার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং নিয়োগ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। এলজিইডির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারতারা তার কথা না শুনলে সে কথিত বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা পরিচয়ে দলবল নিয়ে অফিসারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের মাধ্যমে জোরপূর্বক বিভিন্ন ধরনের কাজের ফায়দা লুটে নিচ্ছে। নিয়োগ বদলি বাণিজ্য ঠিকাদারী কাজের অনৈতিক সুবিধা নিতে সে অফিসারদের বিভিন্নভাবে নাজেহাল করে যাচ্ছে বলেও জানা যায়। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। বিভিন্ন কর্মচারীদের মামলা পরিচালনা ও চাকরি স্থায়ীকরণের আশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষকে সর্বনাশ করে চলেছে সে।

বিভিন্ন সুত্র বলছে, বাবু অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হলেও সে যে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছে তা জাল। কম্পিউটার সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। এমনকি এলজিইডির ইঞ্জিনিয়াররা সরকারি বরাদ্দের গাড়ি না পেলেও ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে ঢাকা মেট্রো-গ ১৫-৪৮১৯ গাড়িটা সে ব্যবহার করে। যা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে দপ্তরটিতে। তার ব্যক্তিগত গাড়ী ব্যবহারের বিষয়টি সরকারি প্রটোকলের সাথে যায় না বলেও অনেকে মনে করে। আর এসব অনৈতিক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সুবিধা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছবি তার ছবির সাথে অফিস কক্ষে টাঙিয়ে দিনের পর দিন বীরদর্পে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম করে যাচ্ছে বাবু। তার হেনস্তার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ভুক্তভোগী দৈনিক সকালের সময়কে জানিয়েছেন, সবাই অফিসে আসে সকালে আর বাবুর অফিস শুরু হয় বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। কেন এতো রাত পর্যন্ত অফিসে থাকে জানতে চাইলে অনেকেই বলেছেন. বিভিন্ন ড্রাইভারের কাছে বাবু মাদক বিক্রি করে।

এরাই হলো তার মূল শক্তি। তার বিরুদ্ধে কেউ টুঁশব্দ করলে এদেরকে শক্তি প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির উপর লেলিয়ে দেয়। যার সর্বশেষ ভুক্তভোগী দৈনিক সকালের সময়ের স্টঠফ রিপোর্টার মোঃ কবির হোসেন। পেশাগত কাজে খোজ খবর নিতে গত ১৬-০৫-২৪ বৃহস্পতিবার এলজিইডি ভবনে গেলে বাবুর হুকুমে আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে বেশ কিছু লোকজন কবিরের উপর হামলা চালায়। এতে কবির মারাত্মকভাবে আহত হয়। তারই প্রেক্ষিতে শেরেবাংলা নগর থানার এসআই ইমরুলের নেতৃত্বে একটি টিম গিয়ে তৎক্ষনাৎ এলজিইডিতে গিয়ে তাকে উদ্ধারসহ ঘটনার সত্যতা পায়।

আঘাত পরবর্তী সময়ে কবিরকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। ভুক্তভোগী এ ব্যাপারে থানায় সাধারণ ডাইরি দাখিল করেছেন। একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে সরকারি আচরণবিধি লংঘন করে তার উপরের বড় বড় কর্মকর্তাদের ভাই সম্বোধন করেও কথা বলতে দেখা গেছে। এলজিইডিতে বৈধ কোন ট্রেড ইউনিয়ন না থাকলেও বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে হুজুর বাবু এলজিইডির মত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে নানা প্রশ্নের সম্মুখিন করছে। তার মত একজন কর্মচারীর আচরণে পুরো এলজিইডি ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, বাবুর মত সন্ত্রাসী লোকের সরকারি চাকরি করার যোগ্যতা অনেক আগেই হারিয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না তা রহস্যজনক। এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে বাবুর +৮৮০ ১৭১১-০৫৪০৫৬ নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন না ধরে কেটে দেন।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন