ডার্ক মোড
Tuesday, 01 July 2025
ePaper   
Logo
আড়াই টাকার গল্প

আড়াই টাকার গল্প

মো.শাহ আলম মিয়া 

 

৪ ঠা ভাদ্র। মেঘহীন আকাশ। কাঠ ফাটা খর-রৌদ্র। সূর্য তখন জগলু মিয়ার তাল্লু বরাবর সরলরেখায় অগ্নি বর্ষণে দৃঢ় স্থির। যেন জগলু মিয়ার মাথার ঘেলু গলানোই ভানুর একমাত্র পণ। 
মেঠো রাস্তা। পাশে হাজা-মজা পুকুর। দূরের আইলে ছইতন বিবি গাই চড়াচ্ছেন তপ্ত রোদে নেয়ে। চোখ ঝলসানো আলো। আকাশে তাকালেই নেত্র বারি পতন। কানে আসে বিদঘুটে ঝিঁঝি পোকার মত ডাক। পুকুরের উল্টো দিকে ত্যাখেঁচড়া বাঁশঝাড়-নিরব কিন্তু দীপ্ত -সংকল্পবদ্ধ -মিসাইলসদৃস ঊর্ধ্বমূখি যেন তপন বধে নিয়ত। ঝাঁড়ের দুটি মিসাইল লক্ষ্যভ্রষ্টে মজা পুকুরে চিৎপটাং। 
পুকুরে হাঁটুকম পঁচা পানি। তেঁসা গন্ধ। মাছ-ব্যাঙ নেই।মৃতপ্রায় জলজ উদ্ভিদও। 
জগলু মিয়া লুঙ্গির মালকোচা দেয়া। ভেজা কোমরঅবধি। অবশিষ্টাংশ ঘর্দমাক্ত। সিন্ট্যার (পাটকাঠি) উপর বসে-হাঁটুভেঙ্গে একমনে কোষ্টা (পাটের আঁশ) ছিলতে ছিলেন। দেখে উঠে এলেন পাড়ে।
 
ভেজা-ফ্যাকাশে হাতে গোঁজানো পলিথিন থেকে বিড়ি ও শলাই নিলেন। দু'বারের ব্যর্থতায় ধরালেন আনছার বিড়ি। ধোয়া ছুটল নাকে-মুখে। এ যেন শক্তি সঞ্চয়ে গরীবের সুধা পান। কথা হলো তখন:
 
ডন্ডিপাড়ার জগলু মিয়া। বয়স- ৬৭। কালচে-তামাটে ভরাট রং। কেশ ঈষৎ শুভ্র। চোখ পাতলা-কিছুটা ঘোলাটে। পান খাওয়া ছাপা রঙিন দাঁত। হাঁড় বুঝা যায়।চামড়া জড়ানো কিন্তু বেশ তেজি। ঋজু কোমর।
 
দিন মজুর। খড়ের ঘর। তিন জনের সংসার। ছেলে দুটি ঘরজামাই। স্ত্রী রুকিয়া অচল গৃহবাসী। একমাত্র মেয়ে স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে পিতৃভর্তৃকা। 
প্রতিদিনের মজুরিতে সংসার চলে। সকাল আটটায় পান্তা-কাঁঠাল খেয়ে এসেছেন মকবুল সাহেবের পাটের আঁশ ছড়াতে। চলবে আসর পর্যন্ত।
 
:ডেইলি কত পান চাচ্ মিয়া?
 :বলতেই জানালেন প্রতিহাতা ২.৫০ টাকা বাপু।
 
:কি বলেন মাত্র ২.৫০ টাকা?
:হ বাপু! তাই পাওয়া যায় না। বয়স হইছে কেউ কামলাও নিতে চায় না। কি আর করমু। যে যা দিতে চায় তাতেই কাম করি দেই। 
 
:কত হাতা হয় প্রতিদিন? 
:৫০/৬০ ট্যা হয় বাপু। আর কামের শরীর নাই।
 
:এ টাকায় কি হয় ব্যাহে?
:হাসিমুখে সবি হয় ব্যাহে। চাউল কিনোম,আলু কিনোম,নুন-আকালী কিনোম,পান কিনোম,২/৫ ট্যাকা পইত (ঘরের বাঁশের খুটিতে ফুটো করে টাকা জমানো) ফ্যালোম।
 
:এতে খাওয়া হয়?
:হয় ব্যাহে, হামার আর খাওয়া। মাইয়াটা খড়ি-শাকসুপ্তা খুঁটি আনে। আন্দোন ভাল। কিন্তু কপালটা ফাটা।
 
:মাছ-মাংস কিনেন না?
:কি যে কন তোমরা। কেমনে কিনমো। হামরা তো আড়াই ট্যাক্যার কামলা। এতো ট্যাক্যা কই পামো বাহে। ঈদোত মাইনষের দেওয়া একনা গরুর গোশত পাছনো তাকে খাইনো। আল্লাহ খাওয়াইলো। 
 
:রোগ-শোক হইলে কি করেন? 
:না হয় না। শান্তিত আছোম। হামার ক্ষুধ্যায় সউগ রোগ খায়া ফেলায়। অইদ-বিষটিতেও (রোদ-বৃষ্টি)  কিচ্ছু হয় না হামার।
 
পুনশ্চ:
হার না-মানা জগলুরাই প্রকৃত পরিতুষ্ট মানুষ,যাদের রক্ত-ঘামে আমরা পারফিউম মাখি।
ফিরে আসুক পাটেরও সোনালী সময়।
 
-স্যালুট কর্মদীপ্ত আড়াই টাকার মালিকদের।
-অতল করুনা অবুঝ নিজেদের।
 


লেখক : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা,মান্দা,নওঁগা

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন