
আখেরি মোনাজাতে বিশ্ব ইজতেমার শেষ পর্ব সমাপ্ত, আমিন ধ্বনিতে প্রকম্পিত তুরাগ তীর
মনিরুল ইসলাম রাজিব টঙ্গী (গাজীপুর)
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনা করে, আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো তাবলিগ জামাত নিজামুদ্দিন মারকাযের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুযারীদের বিশ^ ইজতেমার শেষ পর্ব।ইজতেমা ময়দানের বিদেশি নিবাসের পূর্ব পাশের মঞ্চ থেকে আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলীগ জামায়াতের বিশিষ্ট বুজুর্গ আলেমে দ্বীন মাওলানা ইউসুফ সাদ।
গতকাল রোববার দুপুর ১২টা ৩৭ মিনিট থেকে শুরু করে ১টা ০৭ মিনিট পর্যন্ত আখেরি মোনাজাতে ‘আমীন, আলাহুম্মামীন’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় টঙ্গীর আকাশ-বাতাস।রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় কয়েক লক্ষাধিক মুসল্লি ছাড়াও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন বিশ্বের অর্ধশতাধিক বিদেশি রাষ্ট্রের প্রায় ১ সহস্রাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান।
আখেরি মোনাজাতের কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিল হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদ। সবাই আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
আখেরি মোনাজাতের সময় দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মানুষ এক সঙ্গে হাত তুলেছেন ক্ষমাশীল পরওয়ারদিগারের শাহী দরবারে। গুনাহগার, পাপী-তাপী বান্দা প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চেয়ে কান্নায় চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন।
ইজতেমা ময়দানে রোববার সকাল থেকে দিক নির্দেশনামূলক বয়ান করছেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা মুফতি রিয়াসাত। হেদায়েতের বয়ান করেছেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা জামশেদ। এর পর লাখো মানুষের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে বেলা ১২টা ৩৭ মিনিটে।
জনসমুদ্রে হঠাৎ নেমে আসে আবেগঘন পিনপতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তুলেন আল্লাহর দরবারে। আখেরি মোনাজাতকে ঘিরে লাখ লাখ মুসলমান যেন ভেঙে পড়েছিলেন টঙ্গীতে। আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা টঙ্গী অভিমুখে ছুটতে থাকেন বৃহস্পতিবার থেকেই। বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীরা ছাড়াও কেবলমাত্র আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা বাস, ট্রাক, পিকআপ, মিনিবাস, কার, মাইক্রোবাস, ট্রেনে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করেন। রোববার সকাল থেকে সড়ক-মহাসড়ক ও নদীপথে টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার শুরু হয়। চারিদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ।
বিদেশি মুসল্লিদের অংশগ্রহণ :
ইজতেমার শেষ পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. সায়েম জানান, রোববার দুপুর পর্ষন্ত ৬৪ রাষ্ট্রের প্রায় এক হাজার ৭০০ মেহমান উপস্থিত হয়েছেন। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, বাহরাইন, কম্বোডিয়া, কানাডা, চায়না, ফিজি, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, সুদান, থাইল্যান্ড, তিউনিশিয়া উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন তাঁবু নির্মাণ করা হয়েছে।
নারীদের অংশগ্রহন:
বিশ্ব ইজতেমার শেষ পর্বের ও পুরুষ মুসল্লিদের পাশাপাশি নারীরা অংশগ্রহন করেছেন। মোনাজাতে শরীক হতে সকাল থেকে ময়দানের চারপাশে বিভিন্ন অলি-গলির খালি জায়গায় বসে হাজার হাজার মহিলা আখেরি মোনাজাতে শামিল হন।টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের চারপাশে মিলগেট, কলেজগেট, স্টেশন রোড, টঙ্গী বাজার, কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুরসহ ময়দানের চারদিকে রাস্তার পাশে ও ফুটপাতে নারীরা বসে মোনাজাতে শরিক হন।
টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ইজতেমায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মুসল্লিরা পেটের পীড়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগে আত্রæান্ত হয়েছে। তিন পর্বের ইজতেমায় কয়েক হাজার অসুস্থ্যদের চিকিৎসা করা হয়ছে।
জঙ্গি হামলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আটক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা:
বিশ্ব ইজতেমায় জঙ্গি হামলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আটক রনি সরকার (৩৮) নামে এক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শনিবার রাতে তার বিরুদ্ধে নাশকতার চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়। সেই মামলায় রনিকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।রনি জয়দেবপুর থানার বাড়িয়া ইউনিয়নের আতুরী গ্রামের গিয়াস উদ্দিন সরকারের ছেলে। তিনি বাড়িয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি পদে ছিলেন।
রোববার কাপাসিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন বলেন, রনি সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে নাশকতার চেষ্টা করার অভিযোগে মামলা হয়েছে। তাকে সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
টঙ্গী পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হাবিবুল্লা ইসকান্দার জানায়, ইজতেমায় দুইশতাধিক পকেটমারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মোনাজাত শেষে ঘরে ফেরা মানুষের ভোগান্তি:
আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর এক সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ফিরতে শুরু করলে সর্বত্র ভীড় হয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও আশুলিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল সচল থাকায় ফিরতি মুসল্লিদের যাত্রা সহজ ছিল।৩-৪ দিন ধরে টঙ্গীতে জমায়েত হওয়া মুসল্লিরা আখেরি মোনাজাতের পর একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরছেন। মোনাজাতের পর সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। তবে অধিকাংশ যানবাহন যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক মুসল্লি।