
সত্য বলার সাহস দাও, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাও
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
গাজীপুরের জনবহুল এক এলাকায় পড়ে ছিল এক সাংবাদিকের নিথর দেহ। পত্রিকার ভেতরের পাতায় এক ইঞ্চি জায়গা পেলো সে, টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে গেল মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড, আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকটি হ্যাশট্যাগের দয়া পেল। এভাবেই আমাদের দেশে সত্য বলার মাশুল হিসেবে একজন সাংবাদিকের মৃত্যুও এখন নীরবতায় হারিয়ে যায়।
জাতীয় শোক নেই, মন্ত্রীর চোখে জল নেই,সরকারের বিবৃতিও নেই। কারণ মৃত ব্যক্তিটির নামের পাশে কোনো পদবী ছিল না। তিনি “শুধু” একজন সাংবাদিক ছিলেন। তাও আবার স্থানীয়! আরও মারাত্মক অপরাধ ছিল তার—তিনি সত্য বলতেন।
আজকের বাংলাদেশে সত্য হয়ে উঠেছে এক বিপজ্জনক বস্তু। এক সময় এই সত্য মুক্তি এনে দিত, আজ সে-ই সত্য মৃত্যু ডেকে আনে। গাজীপুরের এই সাংবাদিক স্থানীয় দুর্নীতি, ভূমি দখল ও চাঁদাবাজি নিয়ে অনুসন্ধান করতেন। মানে, অপরাধ করতেন। কারণ এখন প্রশ্ন করাটাই অপরাধ, আর উত্তর খুঁজলেই বিপদ।
সাংবাদিকতা এখন ছুরি হাতে তরমুজ কাটার চেষ্টা—যেখানে তরমুজ তো কাটে না, বরং ছুরিটা নিজের গলাতেই ফিরে আসে। সাংবাদিকতার ক্লাসে এখন আর “সত্য প্রকাশের নৈতিকতা” না শিখিয়ে শেখানো উচিত “কাকে ফোন দিলে জামিন হয়, কীভাবে নাম না দিয়ে রিপোর্ট ছাপা যায়।” কারণ আত্মরক্ষা এখন মৌলিক পাঠ্য।
বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা নতুন কিছু নয়। ২০১২ সালের সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অগণিত সাংবাদিক নিখোঁজ, খুন, গুম কিংবা পঙ্গু হয়েছেন। প্রতিটি ঘটনার পরে একই নাটকীয় চিত্রনাট্য: “আমরা দুঃখিত, তদন্ত চলছে, দোষীদের শাস্তি হবে।” সেই তদন্ত আর শেষ হয় না। দোষীরা থেকে যায় অজ্ঞাতনামা, আর সত্য বলার সাহসীরা চলে যান কবরস্থানে।
গাজীপুরের ঘটনাও সেই চক্রেরই অংশ। সেখানে এক সাংবাদিক স্থানীয় প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের কুকর্ম নিয়ে অনুসন্ধান করায় তাকে হত্যা করা হয়। অথচ কেউ সরাসরি খুনির নাম উচ্চারণ করতে সাহস পান না। কারণ খুনির পরিচয় যত স্পষ্ট, তার ছায়া তত দীর্ঘ।মনে হচ্ছে সাংবাদিকের লেখা "সত্য মানেই শত্রু।” আমরা এমন এক দেশে বাস করি, যেখানে সত্য বললেই বলা হয়, “তুমি কি রাষ্ট্রবিরোধী?”
রাষ্ট্র বলে—“সাংবাদিকদের জন্য আইন আছে।” হ্যাঁ, আছে বৈকি! ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, সাইবার অপরাধ আইন—সবই ব্যবহৃত হয় মূলত সাংবাদিক দমন ও ভয় দেখানোর জন্য। এসব আইনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে এখন সাংবাদিকরা নিজেরাই নিজেদের সেন্সর করে ফেলেন। প্রতিবেদন লেখার আগে কলম থেমে যায়। নিজেকেই প্রশ্ন করেন—“এটা লিখলে কি কাল অফিসে ফিরতে পারব?”
“রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF)” এর ২০২৫ সালের গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম। অথচ এই দেশেই এক সময় সংবাদপত্রের সম্পাদকরা জেলে গিয়েছেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য, কলম ধরেছেন গলাকাটা ঝুঁকি নিয়ে। আজ সেই ঐতিহ্য কাঁদে। এখন কলম বিক্রি হয়ে যায় বিজ্ঞাপনের কাছে, আর সত্য ঘুমায় গাজীপুরের কোনো কবরস্থানে।
সাংবাদিকতা এখন এমন এক পেশা যেখানে সম্মান নেই, বেতন নেই, নিরাপত্তা নেই—কিন্তু শত্রু আছে অনেক। যেকোনো সময় এক ফোনেই কণ্ঠ থেমে যেতে পারে, জীবিকা বন্ধ হতে পারে, এমনকি জীবনও।
গাজীপুরের নিহত সাংবাদিকের পরিবার বিচার চায়, অথচ রাষ্ট্র যেন অন্ধ, বধির, নির্বাক। সাংবাদিকদের প্রাণের মূল্য এখন কাগজের খরচের চেয়েও কম।
এরপরও আমরা যদি বলি, “এই দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে,” তবে সেটা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। গলা চেপে ধরলে চিৎকার থেমে যায়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষ শান্তিতে আছে।
গাজীপুরে সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় সাংবাদিক সমাজও প্রায় নিশ্চুপ। কেউ চুপ আছেন নিরাপত্তার জন্য, কেউ চুপ থাকেন সুবিধার জন্য। কিছু প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে ঠিকই, তবে সেখানে ব্যানার বড়, জনসমাগম ছোট। এই সমাজে এক নীরবতা জন্ম নিচ্ছে—যেখানে সবাই জানে কী হচ্ছে, তবু কেউ মুখ খোলে না।
এই চুপচাপ সম্মতি আসলে অন্যায়কে আরও বেশি শক্তিশালী করে তোলে। আর যিনি সত্য বলেন, তাঁকে বিদায় জানানো হয়—কখনো সম্মাননায়, কখনো দাফনে।
গাজীপুরের সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড আমাদের আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—এই দেশে সত্যের দাম এখন রক্ত। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কী চাই—একটি ভীত, নিঃশব্দ সমাজ? নাকি এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে সত্য বলার সাহসকে বাঁচিয়ে রাখা হবে?
যদি সত্য বাঁচাতে চাই, কলমকে বাঁচাতে চাই, তবে এখনই বলতে হবে—“সত্য বলার সাহস দাও, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাও।”
না হলে যারা আগামীকাল সত্য বলার চেষ্টা করবে, তাদের ঠিকানাও গাজীপুরের মতো কোনো গোরস্থানে লেখা থাকবে।
গবেষক ও সমাজকর্মী