ডার্ক মোড
Tuesday, 26 August 2025
ePaper   
Logo
বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠি: একটি আত্মজীবনীর মহাকাব্য

বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠি: একটি আত্মজীবনীর মহাকাব্য

 

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক

জীবন এক অদ্ভুত খেলা। কখনও আমরা কোনো মানুষকে চোখের সামনে থেকে হারাই, কিন্তু তার ছায়া, চিন্তা ও সংগ্রাম যেন আমাদের সঙ্গে থেকে যায়। বিভুরঞ্জন সরকার সেই দীর্ঘশ্বাসের নায়ক। তিনি চলে গেছেন অজানা দেশে, কিন্তু তার খোলা চিঠি রেখে গেছেন আমাদের জন্য এক আত্মজীবনীর মহাকাব্য হিসেবে । এটি শুধুই ব্যক্তিগত ইতিহাস নয়; এটি সমাজ, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং মানুষের অন্তর্মুখী আবেগের প্রতিচ্ছবি।

চিঠি হাতে নিলে প্রথম অনুভূতি যে জন্মায়, তা হলো—এটি কোনো সাধারণ চিঠি নয়। এটি এক জীবনের মহাকাব্য, যেখানে ব্যক্তিগত আঘাত, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং সামাজিক মন্তব্য একে অপরের সঙ্গে লিপ্ত। পড়তে বসলে পাঠক প্রায়শই বিভ্রান্ত হয়—আমরা কি কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ পড়ছি, নাকি একজন মানুষের অন্তর্মুখী জীবনকাহিনী?

প্রতিটি বাক্যই যেন জীবনের এক অধ্যায়। কখনও নাটকীয়, কখনও কাব্যিক, আবার কখনও সরল ও প্রাঞ্জল। বিভুরঞ্জনের ভাষা পাঠকের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে। আমরা তার ব্যথা অনুভব করি, হতাশা বুঝি, আশা ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করি। এটি কেবল লেখা নয়; এটি জীবনের এক দৃশ্যপট, যা পাঠককে লেখকের সঙ্গে একাত্ম করে।

চিঠির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনকে সমন্বিত করা। প্রিয়জনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, দেশের সঙ্গে টানাপোড়েন, নিজের জীবনের ক্ষতচিহ্ন—সবই একত্রে উঠে এসেছে। কখনও পাঠক তার ব্যথা অনুভব করবে, কখনও তার গর্বের সঙ্গে মিশে যাবে, আবার কখনও হঠাৎ হতাশার ছায়া ঢেকে দেবে। এটি কেবল চিঠি নয়; এটি জীবনানুভূতির এক নাট্যরূপ।

চিঠিতে ক্ষমতাসীনদের অহংকার, বিরোধীদের কৌশল, প্রশাসনিক অদক্ষতা—সবই প্রকাশিত হয়েছে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের আড়ালে, যা পাঠককে হাসায়, ভাবায় এবং কখনও হতাশ করায়। বিভুরঞ্জন যেন বলছেন, “দেখো, এই খেলায় সবাই প্রতারণা করছে, কিন্তু আমার গল্প আলাদা হবে।” ব্যঙ্গের সঙ্গে ব্যক্তিগত আবেগের সংমিশ্রণ চিঠিটিকে সাহিত্যিকভাবে শক্তিশালী করেছে।

চিঠির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো আত্মজীবনী ও মহাকাব্যের সংমিশ্রণ। একজন মানুষ চলে গেলেও তার লেখা, চিন্তা, দর্শন—সবই আমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে। এটি শেখায়, জীবন শুধুই দৈহিক উপস্থিতির নাম নয়; জীবন হলো চিন্তা, অনুভূতি ও সৃজনশীলতার সমাহার। বিভুরঞ্জনের খোলা চিঠি সেই সমাহারের নিদর্শন।

চিঠির প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চরিত্র যেন বৃহত্তর সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রতীকের মতো কাজ করছে। বিভুরঞ্জন নিজেকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, কখনও নিজের জীবনের ন্যায়বিচারের জন্য, কখনও দেশের বা সমাজের প্রতিফলনের জন্য। পাঠক সহজেই বুঝতে পারে, লেখক শুধু নিজের জীবনকাহিনী লিখছেন না; তার জীবনের মাধ্যমে সমগ্র সমাজকেই বিচার করতে চাইছেন।

চিঠি শুধু ব্যক্তিগত কাহিনী নয়; এটি সমসাময়িক রাজনৈতিক চিত্রও ফুটিয়ে তোলে। ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিভুরঞ্জনের জীবনকাহিনী পাঠককে শেখায়, প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে যুক্ত এবং প্রতিটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক প্রতিফলন ঘটায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চিঠি কেবল একটি ব্যক্তিগত নথি নয়; এটি এক সামাজিক মহাকাব্য।

চিঠি একটি মনস্তাত্ত্বিক ভ্রমণও বটে। বিভুরঞ্জন জীবন, বাস্তবতা এবং মানুষের জটিল আবেগকে সংহতভাবে তুলে ধরেছেন। তার অনুপস্থিতি শূন্যতা নয়; বরং এটি আমাদের জন্য এক সাহিত্যিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। আমরা তার লেখা থেকে বুঝতে পারি, একজন মানুষ শারীরিকভাবে অনুপস্থিত হলেও তার চিন্তা ও মূল্যবোধ চিরকাল বাঁচতে পারে।

বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠি একটি অনন্য সাহিত্যকর্ম। এটি পাঠককে জানায়, চিঠি কেবল তথ্য বা অভিযোগের মাধ্যম নয়; এটি হতে পারে এক জীবনের মহাকাব্য, যেখানে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সব স্তর একত্রিত হয়। প্রতিটি জীবন, প্রতিটি অভিজ্ঞতা—যত ছোট বা বড় হোক না কেন—সাহিত্যিক চেতনার মাধ্যমে মহাকাব্যিক রূপ পেতে পারে। এটি শুধু একটি চিঠি নয়; এটি জীবনের নন্দনকাব্য, যা পাঠককে ভাবায়, হাসায় এবং কখনও হতাশাতেও ফেলে।

তিনি চলে গেছেন অজানা দেশে, কিন্তু তার আত্মজীবনীর মহাকাব্য চিরকাল বেঁচে থাকবে—হাসি, বেদনা, ব্যঙ্গ এবং ন্যায়বিচারের এক অব্যর্থ নকশা। পাঠক হিসেবে আমাদের কাজ হলো সেই মহাকাব্যকে পড়া, অনুভব করা এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ করা। বিভুরঞ্জন সরকার দেখিয়েছেন, জীবন শুধু চলার নাম নয়; জীবন হলো সাহিত্য, জীবন হলো মহাকাব্য, জীবন হলো আমাদের জন্য অব্যর্থ শিক্ষা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রম্য লেখক
ইমেইল: fokoruddincse@gmail.com

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন