ডার্ক মোড
Tuesday, 26 August 2025
ePaper   
Logo
ক্ষমতার হাট: প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কতটুকু

ক্ষমতার হাট: প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কতটুকু


 ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক

বাংলার রাজনীতি আজ যেন এক জমজমাট মেলা—নাম তার ক্ষমতার হাট। এখানে চাল-ডাল, কাপড় বা মিষ্টির দোকান নেই; তবুও মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। কারণ এই হাটে বিক্রি হয় প্রতিশ্রুতি, স্লোগান আর আশার মোড়কে মোড়ানো রঙিন স্বপ্ন। ক্রেতা হলো সাধারণ মানুষ, আর বিক্রেতা—রাজনীতির অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা, যারা ক্ষমতার মুনাফা তুলতে চান শব্দের ঝলমলে প্যাকেটে।

এই হাটের ব্যবসায়ীদের চরিত্রও বিস্ময়কর। একসময় মঈন সাহেবের দোকানে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল—“নীতিই সবকিছু”। তখন মানুষ তার কাছে যেত সততা, ন্যায় আর মূলনীতির খোঁজে। কিন্তু সময়ের হাওয়া বদলাতেই সেই বোর্ডে উঠে এলো নতুন বাণী—“সময়ই সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি”। এ যেন গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, যেখানে আদর্শের স্থায়িত্ব নেই; আছে শুধু পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার দক্ষতা।

এই হাটে একসময়ের শত্রুরা আজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একই টেবিলে বসে গল্প করছে। গতকাল যাদের বলা হয়েছে “জাতির শত্রু”, আজ তারা “দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষক” হয়ে উঠেছে। দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া—নাকি ক্ষমতার ভাগাভাগির চুক্তি? ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, রাজনীতির বন্ধুত্ব ও শত্রুতা আসলে স্বার্থের ওঠানামার সাথে বদলায়। শীতল যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেমন হাত মিলিয়েছিল, তেমনি আজকের মিত্ররা কালই প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে।

সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো “বাক্সবদল”। নির্বাচন সামনে আসলেই পুরনো প্রতিশ্রুতির বাক্স খোলা হয়, ভিতরের কথা নতুন মোড়কে সাজিয়ে ভোটারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ভোটাররা নতুন বাক্স হাতে নেয়, কিন্তু খুলে দেখে—ভিতরে আগের সেই কথাই, কেবল মোড়ক পাল্টেছে। এই খেলায় বিভ্রান্ত হয়ে অনেক ভোটার পুরনো ভুল আবারও পুনরাবৃত্তি করেন।

৭০ ও ৮০-এর দশকের রাজনীতি ছিল তীব্র সংঘর্ষ, সহিংসতা আর মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে সেই শত্রুরাই আজ ক্ষমতার টেবিলে পাশাপাশি বসে হাসিমুখে ছবি তুলছে। এটি প্রমাণ করেছে—রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু নেই, আছে শুধু চিরস্থায়ী স্বার্থ। এই বাস্তবতা গণতন্ত্রের অংশ হলেও, যখন স্বার্থই একমাত্র চালিকা শক্তি হয়, তখন তা জনগণের মনে হতাশা ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়।

তবুও গণতন্ত্রের আসল শক্তি জনগণের হাতে। ভোটাধিকার হলো সেই একমাত্র হাতিয়ার, যা দিয়ে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণ করতে পারে। তারা জানে, রাজনীতিতে “শেষ কথা” বলে কিছু নেই; প্রতিটি সমাপ্তি আসলে নতুন শুরুর ইঙ্গিত। তবে সেই শুরুর সার্থকতা নির্ভর করে ভোটারের সচেতনতার ওপর। অন্ধ আবেগ নয়, বরং তথ্য, যুক্তি ও অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এটাই গণতন্ত্রের প্রাণ।

এক প্রবীণ রাজনীতিক একবার বলেছিলেন, “রাজনীতি নদীর মতো—স্রোত বদলালে দিকও বদলায়, কিন্তু নৈতিকতার বীজ যেন কখনও শুকিয়ে না যায়।” নমনীয়তা প্রয়োজন, তবে তা হতে হবে দেশের কল্যাণ ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। কারণ দিক পরিবর্তন যদি হয় কেবল ক্ষমতার জন্য, তবে সেই স্রোত গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই শুকিয়ে যাবে।

মূলত ক্ষমতার হাটে শেষ কথা নতুন দৃশ্যের শুরু। তাই জনগণের দায়িত্ব হলো নাটকের মঞ্চের পেছনের চিত্রনাট্য বোঝা, প্রতিশ্রুতির ঝলমলে মোড়ক সরিয়ে ভেতরের আসল কথা বের করা। আমরা সবাই এই নাটকের দর্শক ও অংশীদার—ক্রেতা ও বিক্রেতা একসঙ্গে। যতদিন আমরা সচেতন থাকব, ততদিন গণতন্ত্র বাঁচবে, দেশ এগিয়ে যাবে।

প্রতিদিন এই হাট নতুন রঙে সেজে ওঠে। নতুন মুখ, নতুন ভাষণ, নতুন স্লোগান—সবই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। জনগণ আশা করে, প্রতিটি নতুন বাক্সে আগের ভুলগুলো সংশোধিত হবে, নতুন চিন্তা ও উন্নয়নের পরিকল্পনা আসবে। কিন্তু সেই আশা পূরণ হবে তখনই, যখন রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতিকে কাগজের বুলি থেকে তুলে বাস্তবতার মাটিতে রোপণ করবেন।

জনগণ চায় এমন রাজনীতি, যেখানে ক্ষমতা হবে সেবার হাতিয়ার, শোষণের নয়; যেখানে ভোটারের বিশ্বাস হবে অটুট, আর রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা হবে প্রশ্নাতীত। যদি তারা দেশের স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে রাখেন, তবে ক্ষমতার হাট সত্যিকারের জনমঞ্চে পরিণত হবে।

আরেকটি সত্যও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—গণতন্ত্র কেবল ভোটের দিন নয়, প্রতিদিনের আচরণ ও দায়িত্বের মধ্যে বেঁচে থাকে। নীতি, জবাবদিহি ও জনআস্থার চর্চা ছাড়া গণতন্ত্র কেবল সাজানো মেলার মতো, যা দূর থেকে সুন্দর কিন্তু কাছে গেলে ফাঁপা।

ক্ষমতার হাট চলতে থাকবে যতদিন আমাদের হাতে ভোটের অধিকার আছে, যতদিন আমরা দেশের ভাগ্য গড়ার দায়িত্ব বুঝি। এর বাইরে কোনো বিকল্প নেই—কারণ গণতন্ত্র কেবল অধিকার নয়, প্রতিদিনের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনেই আমাদের মুক্তি, আমাদের অগ্রগতি।

তাই আসুন, এই হাটকে শুধুই নাটকের মঞ্চ না বানিয়ে দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের আসল মিলনস্থল বানাই। যেখানে ভোটাররা সচেতনভাবে নেতৃত্ব বেছে নেবে, আর রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতিকে কর্মে পরিণত করবেন। তখন প্রতিশ্রুতির শব্দ আর খালি বুলি থাকবে না—তা হবে উন্নতির সোপান, জাতির ভবিষ্যতের দৃঢ় ভিত্তি।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রম্য লেখক
ইমেইল - fokoruddincse@gmail.com

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন