ডার্ক মোড
Tuesday, 26 August 2025
ePaper   
Logo
আ.লীগ কি ফিরবে নাকি ফিরবে না

আ.লীগ কি ফিরবে নাকি ফিরবে না

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক

বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে আওয়ামী লীগের নামটি যেন এক প্রাচীন নাট্যমঞ্চের স্থায়ী চরিত্র—যে কখনো মঞ্চের কেন্দ্রে আলোয় ভেসে ওঠে, আবার কখনো আড়ালে গিয়ে সংলাপ মুখস্থ করে। নাটকের কাহিনি বদলায়, পটভূমি বদলায়, এমনকি অনেক অভিনেতা বদলে যায়—কিন্তু এই চরিত্রের নাম মুছে ফেলা যায় না ইতিহাসের খাতা থেকে। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই চরিত্র কি আবার আলোর বৃত্তে ফিরবে, নাকি পর্দার আড়ালেই থেকে যাবে?

দীর্ঘদিন ক্ষমতার থাকা সত্ত্বেও ৫ই আগস্ট ২০২৪ এর পর আজ আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে আছে রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে। তাদের ঝুলিতে আছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব, স্বাধীনতার জয়গান, রাষ্ট্রগঠনের প্রথম স্বপ্ন, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঝলমলে অ্যালবাম। কিন্তু একই ঝুলিতে জমেছে কিছু সুবিধাভোগী ,অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিডদের অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহারের কালো ছায়া। এই দুই বিপরীত স্রোতের মাঝপথে দলটি এখন যেন নদীর মাঝখানে নোঙর করা নৌকা—জোয়ারের অপেক্ষায়, অথচ দূর আকাশে কালো মেঘ জমে উঠছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে—ক্ষমতা হারানো মানেই সমাপ্তি নয়। বিএনপি যেমন পতনের পরও ফিরে এসেছে, আওয়ামী লীগও এসেছে বারবার—কখনো জনতার ঢেউয়ে ভেসে, কখনো আন্তর্জাতিক কূটনীতির স্রোতে। তাই ফিরে আসা তাদের জন্য কেবল সম্ভাবনা নয়, বরং পরীক্ষিত বাস্তবতা। তবে এবার পথের কাঁটা আরও তীক্ষ্ণ, ঢাল আরও পিচ্ছিল, আর সেতুটি আরও অনিশ্চিত।

ফিরে আসার জন্য প্রথম কাজ হতে হবে ভেতরের দেয়াল মেরামত। দীর্ঘ ক্ষমতাকালে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও তৃণমূলের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা কমানো ছাড়া জনমানসে বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ভাষাও বদলাতে হবে—যেখানে প্রতিশ্রুতি শুধু প্রচারণায় নয়, কার্যকর নীতিতে প্রতিফলিত হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিতে হবে স্পষ্ট অবস্থান—গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্বচ্ছ শাসনের বিষয়ে, কারণ আধুনিক রাজনীতি কেবল দেশীয় মাঠে খেলে জেতা যায় না।

রূপকের ভাষায়, আওয়ামী লীগ একসময় ছিল স্রোতস্বিনী পদ্মা—প্রবল স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে স্বপ্ন, সাহস ও সংগ্রামের গল্প। কিন্তু সময়ের পলি জমে কোথাও কোথাও স্রোত থেমে গেছে, কিছু অংশ শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। এখন প্রশ্ন—এই নদী কি আবার বর্ষায় জেগে উঠবে, নাকি ভাটার টানে হারিয়ে যাবে পুরনো পথে?

ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের পতাকা, স্বাধীনতার অগ্রদূত হওয়ার গৌরব—এসব আবেগময় পুঁজি যদি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে ফেরার দরজা খুব দ্রুতই খুলে যেতে পারে। কিন্তু আবেগ একা ভোটের বাক্স পূর্ণ করে না—তার সাথে যোগ হয় বর্তমানের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আছে এক অদ্ভুত পালাবদলের চক্র—যেখানে ক্ষমতাসীন দল তাদের দুর্নীতি অপশাসনের কারণে ধীরে ধীরে বিরোধীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়। আওয়ামী লীগের হাতে এখন সেই সুযোগ আছে এই চক্র ভাঙার—একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার, যেখানে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও নাগরিক স্বাধীনতা—দুই-ই সমান গুরুত্ব পাবে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও অবহেলা করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, চীন—সবাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় স্বার্থ জড়িত রেখেছে। সাম্প্রতিক কূটনৈতিক চাপ কমানো এবং নতুন আস্থা অর্জন করা হবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা অনেকটাই নির্ভর করে বৈশ্বিক সম্পর্কের ওপর।

তবে ক্ষমতায় ফেরা আর ক্ষমতায় টিকে থাকা এক জিনিস নয়। দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ বলছে—দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দল যদি ফেরার পরও পুরনো ভুলে আটকে থাকে, তবে সেই প্রত্যাবর্তন হয় ক্ষণস্থায়ী। পাকিস্তানের পিপলস পার্টি বা ভারতের কংগ্রেসের ইতিহাস এই শিক্ষা দেয়। তাই আওয়ামী লীগের এখনই সময় ভেতরে শুদ্ধি অভিযান শুরু করার—যাতে ফিরে আসা শুধু সম্ভাবনাময় না, দীর্ঘস্থায়ীও হয়।

তরুণ প্রজন্মের মন জয় করা হবে চূড়ান্ত পরীক্ষা। এই প্রজন্ম কেবল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনে সন্তুষ্ট নয়—তারা চায় কর্মসংস্থান, মানসম্মত শিক্ষা, প্রযুক্তি ও স্বচ্ছ প্রশাসন। তাদের উপেক্ষা করলে আওয়ামী লীগের ফেরার পথ আরও দুর্গম হয়ে উঠবে।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা শুধু ‘ফিরবে কি ফিরবে না’ নয়—বরং, ‘ফিরে এলে কেমন রূপে ফিরবে’। তারা কি হবে নতুন স্বপ্নের বাহক, নাকি পুরনো স্লোগানের পুনরাবৃত্তি? উত্তর লুকিয়ে আছে সময়ের সিন্দুকে, আর সময়—সে তো নিরপেক্ষ ইতিহাসের লেখক, যার কলমে আবেগ নয়, সত্যের কালি ঝরে। আজকের দর্শক সেই কলমের লেখা পড়ার অপেক্ষায়, আর আওয়ামী লীগ—তারা প্রস্তুত কি না, সেটিই এখন মূল নাটকের শেষ দৃশ্য।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তক
ইমেইল: fokoruddincse@gmail.com

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন