মেলান্দহে কৃষি-খাদ্য-পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা
মোঃ শাহ জামাল, জামালপুর
জামালপুরের মেলান্দহে ক্রমাগত মাটি লুটের ফলে কৃষি ও পরিবেশ হুমকির মুখে। এতে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা বিদ্যমান। বিশেষ করে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর টপসয়েল হরিলুটের মহোৎসবের চিত্রই তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। উপজেলায় ২৫টি ইটভাটা। এরমধ্যে নয়ানগর ইউনিয়নেই ৮টি। ইটভাটার মাটি খেকুরা কৃষককে এক ধরণের বø্যাক মেইল করে এই সুরক্ষিত মাটি অল্প টাকায় হাতিয়ে নিচ্ছে। টপসয়েলের বিপর্যয় কৃষিতে বড় ধরণের হুমকি এবং খাদ্য সংকটে ফেলবে। অনুমোদনহীন যানবাহনে মাটি বহন করায় ক্ষতি হচ্ছে রাস্তাঘাট পরিবেশও। ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন করায় ক্ষতিগ্রহস্থ হচ্ছে নদ-নদী-কৃষি এবং প্রকৃতিও। সচেতন মহল মনে করছেন, এই বিপর্যয় রোধ এখন সময়ের দাবি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাজরাবাড়ি, ব্রাহ্মণপাড়া, ফুলকোচা, আদ্রা নামাবন্দ, কুলিয়া, দুরমুঠ, দাগি, বানিপাকুরিয়া, উদনাপাড়া, নয়াপাড়া, আলোকদিয়া, বন্দোরৌহা, শাহিন বাজার ছাড়াও প্রায় প্রতিটি গ্রামের টপসয়েল লুটে ব্যস্ত মাটি খেকুরা। আদ্রা বাজারের পাশে লৌহজংয়ের খননকৃত পাড়ের মাটি লুটও থেমে নেই। কৃষক মুনতাজ মিয়া (৫৬) জানান-ইতোপূর্বে এভাবে কৃষি জমিতে মাটি গর্ত করলে ফসল হবে না। সামান্য বৃষ্টিতেই পানি আটকে থাকবো।
হাজরাবাড়ি ব্রাহ্মণপাড়ায় ৮টি ভ্যাকু মেশিন দিয়ে মাটি উত্তোলনকারিদের আব্দুল মজিদ (৪৩) ও মাসুদ (২৫) এর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জানান-প্রশাসনের লোকজন আসছিলেন। মাটিগুলো মাদারগঞ্জের ইটভাটায় বেশি যাচ্ছে। আন্নেরা ভ্যাকু মেশিন মালিক ও মাটির ডিলার সোলায়মান সাবের সাথে যোগাযোগ করেন। উনি হাজরাবাড়ি বাজারে থাকেন। সোলায়মান সাহেব সাংবাদিক আসার খবরে দ্রæত শটকে পড়েন।
জানা গেছে, মেলান্দহ উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার পুকুর আছে। উপজেলার ২৫টি ইটভাটা ছাড়াও ইসলামপুর, মাদারগঞ্জের ইটভাটায় মাটি যাওয়ার ফলে কোন কোন জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিলের সমান কিংবা তার চেয়েও বেশি গভীরতার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ জমিতে ফসল না হওয়ায়, অপরিকল্পিত পুকুর খননে বাধ্য হলেও; মাছ চাষে কাঙ্খিত লাভবান হচ্ছেন না কৃষক। এতে পুকুরের সংখ্যাও বাড়ছে। কমছে আবাদি জমিও। অথচ এসব জমিতে এক ফসলি, দু’ফসলি তিন ফসলি এমনকি বছর জুড়ে আবাদও ছিল। বারোমাসি ফসলের জমি এখন নাই বল্লেই চলে।
মেলান্দহ বঙ্গমাতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণা সেলের পরিচালক ড. মাহমুদুল হাসান জানান- পুকুর পাড়ের বিভিন্ন অংশে টপসয়েল থাকলে মাছ চাষ ভালো হয়। আদর্শ পুকুর হচ্ছে ৫-১০ ফুট উচ্চতার। অনিয়ন্ত্রিত পুকুরে মাছের রোগবালাই আক্রমন করে। মাছ বৃদ্ধি পায় কম। বাকৃবি’র গবেষক শিক্ষার্থী এস.এম. আল-ফাহাদের মতে কৃষি জমির মাটি উত্তোলনের পর, গর্তে অপরিকল্পিত পুকুর রূপ দিয়ে মাছ চাষে কৃষক না পাবে কাঙ্খিত মাছ। না পাবে ফসল। হারাবে ফসলি জমি এবং হারাবে পৃথিবীর গতি ও প্রকৃতি।
ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ আবুল বাশার জানান-মাটির ৫টি লেয়ারের প্রথম স্তরের ২-৮ ইঞ্চি পর্যন্ত টপসয়েল। টপসয়েলে বেশি জৈব পদার্থ, হিউমাস উদ্ভিদ ও প্রাণীর পঁচা বা অবশিষ্টাংশ ডিকম্পোজ থাকে। এ ছাড়াও খনিজ উপাদান, পানি-বায়ুর সংমিশ্রণের ব্যবস্থাপনা থাকে। যা মাটির পুষ্টি উপাদানের ক্ষেত্রে প্রাণী ও উদ্ভিদের অনুজীব বেশি কার্যকর। পরিবেশ বান্ধব লেয়ারে থাকে মোহনীয় উর্বরা শক্তি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার ভান্ডার। যা মাটির পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
টপসয়েল না থাকলেই কৃষিতে বিপর্যয়ের আশংকা থাকে। কোন কোন জায়গায় ৪-৬ ফুট কিংবা আরো বেশি পর্যন্ত গভীর করলে মাটিতে পুষ্টি এবং ফসল করার মতো কিছুই থাকে না।
ইট ভাটায় টপসয়েলের চাহিদার কারণ হিসেবে তিনি বলেন-টপসয়েলে ক্লে বা কাদার পরিমান বেশি। যা ইটের আকৃতি-দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে। মাটির অতিরিক্ত প্লাস্টিসিটি (ফোল্ডিং), জৈব পদার্থ ইটকে শেইপ (আকার) দেয়। এতে আছে উচ্চ তাপমাত্রা ধারণ ক্ষমতা। আবার বেশি মাত্রা গভীরতার মাটিও ইটের টেম্পার কম হবে। সেক্ষেত্রেও ইট ব্যবহারকারিরা ঠকবে। এ জন্য ইটের বিকল্পের কথা ভাবা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ইনভাইরো কনসালটেন্সস লিমিটেডের এমডি-পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. জগদীশ সাহা জানান-বাংলাদেশ সরকার বহু আগে থেকেই মাটি-গাছপালা সংরক্ষণে পরিবেশ সম্মত ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিট বøক, ফাইবার সিমেন্ট, ধানের তোষ, বর্জ্য এবং বায়োমেটেরিয়াল ইত্যাদির উপর গুরুত্বারোপ করেছে। অর্থ সাশ্রয়ের চিন্তায় মাটির উপর নির্ভরতা বাড়ছে। মাটি শেষ হলে তখনকার উদ্যোগ কতটুকু কাজে আসবে? এটাই এখন ভাবনার বিষয়। সব মিলে তিনি দেশপ্রেমিক নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেন।
কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল জানান-মেলান্দহে মোট ২৫ হাজার ৮শ; ৪৩ হেক্টর জমি আছে। আবাদযোগ্য জমি আছে ২৩ হাজার ৫শ’ ৩৪ হেক্টর। ইটভাটা এবং মাটি উত্তোলন কিংবা পুকুর খননের জন্য কাওকে কৃষি ও পরিবেশের উপর প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়নি। ২০১৯ সালের দিকে ১টি ইটভাটার জন্য প্রত্যয়ন নিতে আসছিল। আমি নয়ানগর ইউনিয়নের প্রশাসক হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালনের সুবাদে কৃষি জমি থেকে একটি স্পটের মাটি উত্তোলন বন্ধ করে দিতে পেরেছি। এই কাজগুলো বাস্তবায়নে একার পক্ষে সম্ভব নয়। সামাজিক আন্দোলন, নাগরিক সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন প্রয়োগে কঠোরতার প্রয়োজন।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম বাবু এবং পরিবেশ আন্দোলনের জেলা সম্পাদক এড. ইউসুফ আলী মনে করেন-কৃষি-পরিবেশ এবং প্রশাসনের অনুমোতি ছাড়া এই মাটি উত্তোলনে শাস্তির বিধান আছে। কৃষি-পরিবেশের বিপর্যয় রোধ এবং টপসয়েল রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস.এম. আলমগীর জানান-মাটি উত্তোলন কিংবা পুকুর খননের অনুমোদনের জন্য কেও আবেদন করেনি। হাজরাবাড়িসহ কয়েকটি এলাকায় মাটি উত্তোলনের দায়ে মোবাইল কোর্টে জরিমানাও করা হয়েছে। এ ছাড়াও বালু মহাল ও ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনে ২ লক্ষাধিক টাকা জরিমানাও আদায় করা হয়েছে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই দু’একটি ইটভাটা বন্ধ করে দেয়া হয়।