দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে পাহাড়ের সম্ভাবনাময় এ শিল্প
আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি
খাগড়াছড়ির উচু নিচু পাহাড়ের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে যেদিকেই চোখ যায়, সে দিকেই দেখা মিলতো ঝাড়ুফুল যার জাতীয় নাম "উলুফুল"।পাহাড়ের ঢালুতে এ ফুলের বিস্তার হয়ে থাকে।প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ের ঢালুতে গজানো এ ফুল স্হানীয়দের কাছে ঝাড়ুফুল বা "ফুলঝাড়ু" নামেই বেশ পরিচিত।একটি চারা থেকে একটি মাত্র ফুল দেওয়ার পর গাছটি মারা যায়। কিন্তু বৃষ্টি পড়ার পরপরই মূল থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়।চাষ বা কোন পরিচর্চা ছাড়াই পাহাড়ে বুকে প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠা ফুলঝাড়ু বেশ পরিচিত লাভ করেছে।
খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলার দুর্গম পাহাড় জুড়ে এ ফুল বেশি দেখা যায়,প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এই ঝাড়ুফুল দেখতে অনেকটা কাশফুলের ডাঁটার মতো। শীত শুরু হওয়ার পরপরই এসব গাছে ফুল আসে। ডিসেম্বরের মধ্যেই "ঝাড়ুফুল" পরিপূর্ণতা পায়। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয় ফুল।
ইতোমধ্যে পাহাড় থেকে ঝাড়ু তৈরির জন্য ‘ঝাড়ুফুল’ কাটা শুরু হয়েছে। গহীন পাহাড় থেকে এ ফুল সংগ্রহ করা শুরু করেছে সংগ্রহকারীরা। পাহাড় থেকে ‘ফুল ঝাড়ু’ কেটে বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে আসেন স্হানীয় লোকজন। ফুলঝাড়ুর ২০-২৫টি কাঠি নিয়ে একটি আটি বাঁধা হয়। বন বিভাগের ভাষায় এটির নাম ‘ভ্রুম’। স্থানীয় চাকমা ভাষায় এ ফুলের নাম চড়ন্দরা, ত্রিপুরা ভাষায় চন্দ্রা,আর মারমা ভাষায় ইনহেজা বলা হলেও সারাদেশে ফুলঝাড়ু বা ঝাড়ুফুল নামেই পরিচিত।
খাগড়াছড়ির বিভিন্ন বাজার গুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সড়কের পার্শ্বে "ঝাড়ুফুল"গুলোকে আঁটি বেঁধে সারি সারি ভাবে সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে আবার স্হানীয়দের কাছ থেকে কম দামে ক্রয় করে পাইকারদের কাছ থেকে বেশি লাভে বিক্রির আশায় "ফুলঝাড়ু" নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
২০ /২৫টি কাটি দিয়ে একটি ঝাড়ুর আটি বাঁধা হয়। আটির আকার ও মানভেদ নির্ণয় করে ২০/৩০ টাকা বিক্রি হয়। হাত বদলে ঝাড়ু ফুলের এই আটি ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এক বান্ডিলে ৫০/১০০ টি আটি থাকে। প্রতিটি বান্ডিল ৯০০ থেকে শুরু করে ২৫০০শতটাকা বিক্রি করা হয়। বান্ডিল ও প্রকারভেদে মূল্য নির্ধারণ হয়ে থাকে।
এরপর বাজার থেকে স্থানীয়রা ব্যবহারের জন্য সেগুলো কিনে নেয়। ঢাকা,চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও দেশের বড় বড় শহর থেকে আগত পাইকারী ব্যবসায়ীরা স্থানীয় বাজারগুলো থেকে ফুল ঝাড়ু কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন বাজার গুলোতে সরবারহ করেন। সমমায়িক এ "ফুলঝাড়ু"এলাকার মানুষের আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।খাগড়াছড়ি, পানছড়ি, দীঘিনালা,মহালছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা,রামগড়,মানিকছড়ি, লক্ষীছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে ফুলঝাড়ুর আড়ত ও মাঠ। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এসব আড়ত ও মাঠে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ফুলঝাড়ু।
প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত পাহাড়ের এই ‘ফুলঝাড়ু’ ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে দোকান পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিদিনই ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রতিবছর `ঝাড়ুফুল` দেশের গন্ডি পেরিয়ে মধ্যেপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।প্রাকৃতিক এ ‘ঝাড়ু ফুল’ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে পাহাড়ে বসবাসরত বহু পরিবার। এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে পাহাড়ের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
স্হানীয় "ঝাড়ুফুল" সংগ্রহকারী হারাধন ত্রিপুরা দৈনিক আমার বাঙলাকে বলেন, প্রতিবছর জেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকার উচু নিচু পাহাড়ের ঢালু হতে জীবনের ঝুকি নিয়ে কেটে আনতে দ্বিগুন মূল্য পরিশোধ করতে হয় শ্রমিকদের । এই কাঁচা ফুল গুলো এনে আটি বেধে স্তূপ করে রাখা ও সাপ্তাহিক হাট বারের দিনে সকালে ট্রাকে করে বাজারে নিয়ে আসা হয়। প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার বান্ডিল "ঝাড়ুফুল"সংগ্রহ করি। সে অনুযায়ী ন্যাযমূল্য পাওয়া যায় না।
স্হানীয় ফুলঝাড়ু আড়ৎদার মোঃ আবদুল করিম বলেন,পাহাড়ে রাস্তার ধারে ধারে কয়েক বছর আগেও এ ফুল পাওয়া যেত। নির্বিচারে পাহাড়ি বনজ সম্পদ বন নিধনের ফলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ও সম্ভাবনাময় "ফুলঝাড়ু" দিন দিন কমে যাচ্ছে। দুর্গম এ উচুনিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ফুল ঝাড়ু কেটে আনতে হয়।যার ফলে দামও একটু বেশি।
চট্রগ্রামের ঝাড়ু ফুলের পাইকারী ব্যবসায়ী সরাফত উল্ল্যাহ দৈনিক আমার বাঙলাকে জানান, ২৭ বছর ধরে পাহাড়ে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষের কাছ থেকে কাঁচা আটি ১০ থেকে ১৫ টাকা পাইকারি দরে "ঝাড়ুফুল" কিনে নেই।
তারপর রোদে শুকিয়ে শ্রমিক দিয়ে নতুনভাবে ঝাড়ুর মোচা বানিয়ে ট্রাকে করে ঢাকা-কুমিল্লায় নিয়ে ৪০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করি। ১৯৯৬ সালে প্রথম ঝাড়ু ব্যবসা শুরু করেন তিনি। বর্তমানে তিন শতাধিক শ্রমিক তার অধীনে "ঝাড়ুফুল"রোদে শুকানো এবং ঝাড়ুর আঁটি বাধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। আমি মনে করি সরকারি ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে আত্বকর্মস্হান ও পাহাড়ের মানুষের আর্থিক সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারবে এই শিল্প।
তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই ফুলঝাড়ু সরবরাহ করতে সড়কের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে গাড়ীসহ মাল আটক ও গাড়িতে অবৈধ জিনিস আছে বলে হেনস্তার স্বীকার হতে হয় এমনটাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।বন বিভাগ সুত্রে জানা যায়,বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা হলে, পাহাড়ের নিম্মআয়ের মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে যেমন সচ্ছল হবে তেমনি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে জম্ম নেয়া এই ফুল যা মানুষের দৈন্দিন জীবনের ঘর পরিস্কার পরিছন্ন রাখার কাজে ব্যবহারিত হচ্ছে। তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে এই ফুলঝাড়ু। যা থেকে রাজস্ব জমা হয় সরকারের তহবিলে।