দাম বাড়তেই সয়াবিনে সয়লাব বাজার, লাভের ষোলো আনাই ব্যবসায়ীদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে প্রায় দুই মাস আগে সরকারকে চাপ দিয়ে ভোজ্য তেল আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট কমিয়ে নেয় তেল ব্যবসায়ীরা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে সরকারের লক্ষ্য দাম না বাড়িয়ে শুল্ক সুবিধা দিয়ে হলেও তেলের সরবরাহ ঠিক রাখা। কিন্তু প্রায় মাসের ব্যবধানেই ফের উল্টো পথে ব্যবসায়ীরা। শুল্ক ও ভ্যাটে ছাড়ের সুবিধা নেওয়ার পরই তেলের সরবরাহ কৃত্রিমভাবে বন্ধ রেখে সরকারকে চাপ দিয়ে আবার সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে নিয়েছেন তারা। এর ফলে মূল্য ভোক্তার নাগালের বাইরে গেলেও লাভের ষোলো আনা তেল ব্যবসায়ীদেরই। বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন গতকাল সোমবার সচিবালয়ে ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর সয়াবিন তেল ও পাম তেলের নতুন দাম ঘোষণা করেন।
আজ মঙ্গলবার থেকে এ দুটি ভোজ্য তেলের নতুন দাম কার্যকর হবে। ফলে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন থেকে বিক্রি হবে ১৭৫ টাকায়, যা এত দিন ছিল ১৬৭ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৬০, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিনের সভাপতিত্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোজ্য তেলের মূল্য সমন্বয়সংক্রান্ত বৈঠক হয়। সেখানে তেলের সরবরাহ ঠিক রাখতে তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে প্রধান সিদ্ধান্ত সয়াবিন তেল লিটারে বাড়বে ৮ টাকা। যদিও রমজানের আগে কোনো পণ্যের দাম বাড়ানোর পক্ষে ছিল না সরকার। গত এক মাস ধরে তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন তেল ব্যবসায়ীরা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাতে সায় দেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে টানা এক সপ্তাহ বাজারে তেল সরবরাহ বন্ধ রেখে ভোজ্য তেল পরিশোধন কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের জিম্মি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে আবারও তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে ব্যবসায়ীদের নানা নাটকীয়তার পর সরকার লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়ানোর ঘোষণার এক ঘণ্টা পরই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে। আধা লিটার থেকে শুরু করে পাঁচ লিটারের তেল মুদি দোকানগুলোর প্রদর্শনীতে দেখা মিলেছে। একই সময় রাজধানীর কারওরান বাজারে কয়েক ট্রাক তেল নামানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট ও টাউন হল বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
এর আগে টানা এক সপ্তাহ বাজারে তেল সরবরাহ বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গতকাল বিকেলে তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণার এক ঘণ্টার মাথায় কারওয়ান বাজারসহ দেশের বিভিন্ন বাজার তেলে সয়লাব হয়ে পড়ে।
ভোক্তাদের জিম্মি করে দাম বাড়ানোর পক্ষে সাফাই গাইছেন তেল ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়ানোর পর সংবাদ সম্মেলনে ভোজ্য তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘কয়েক দিন থেকে আমরা কীভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করেছি। বিশ্ববাজারে প্রতি টন তেলের দাম ১ হাজার ২০০ ডলারে উঠেছে।’
তিনি দাম বাড়ানোর যুক্তি তুলে ধরে আরও বলেন, ‘গত এপ্রিলে সরকার যখন তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তখন বিশ^বাজারে প্রতি টন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ৩৫ ডলার। এখন আমরা ১ হাজার ১০০ ডলার ধরে লিটারে ৮ টাকা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেওয়া তিনটি সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রথমটি হলো আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা বিবেচনায় এনে অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৭ টাকা, প্রতি লিটার খোলা পাম সুপার তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৭৫ এবং প্রতি পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা ৮৫২ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বিজ্ঞপ্তি জারি করবে।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে আমদানি পর্যায়ে আরোপিত বিদ্যমান সংযোজন করের (মূসক) মেয়াদ ১৫ ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে করে ৩১ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত নির্ধারণ করবে।
আর তৃতীয় সিদ্ধান্ত হলো বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন প্রত্যেক মাসে ৫ তারিখের মধ্যে অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী ভোজ্য তেলের মূল্য সমন্বয়ের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাবে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সে অনুযায়ী সভা করবে।
এর আগে গত ১৫ অক্টোবর স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধি না করে আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ১৫ শতাংশ হতে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ দুই পর্যায়ে মোট ১০ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের আবেদন করে এ মন্ত্রণালয়। পরে সেটি আমলে নিয়ে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ ও স্থানীয় উৎপাদনে মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করে এনবিআর।
দেশে সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করার কারণ ব্যাখ্যা করে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণেই নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে তেলের ঘাটতি রয়েছে, এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, ভোক্তারাও অস্বস্তিতে রয়েছেন। সেজন্য আমরা তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছি। নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি বাজারে আর তেলের ঘাটতি হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত এপ্রিলে ১৬৭ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর এখন পর্যন্ত বিশ^বাজারে দাম অনেকটাই বেড়েছে। যে কারণে দেশে স্থানীয় মজুদদারি বেড়েছে। তেলের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। অনেকে কিনে মজুদ করেছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমরা সেটা মনিটরিং করছি। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে এখন একটি যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর সমস্যা হবে না।’
গতকালের বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খানসহ ভোজ্য তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
দাম বাড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোম্পানিগুলোর কাছে তেলের সংকট নেই। রোজার আগে দাম বাড়ানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই সব ধরনের তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দুই-একটা কোম্পানি সামান্য কিছু সরবরাহ করলেও তা ছিল শর্তসাপেক্ষ। সরকার তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে পুষ্টি, তীর ও ফ্রেশে তেল বাজারে চলে আসে। পাশাপাশি কোম্পানির প্রতিনিধিরা নতুন করে তেলের অর্ডার নেওয়ার জন্য ঘোষণা দিয়েছে।
কারওয়ান বাজারের নোয়াখালী স্টোরের স্বত্বাধিকারী শেখ জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রত্যেক বছর রোজার আগে তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের নানা টালবাহানা দেখা যায়। তবে তা বছর বছর ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হয়। এবারও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। গেল সপ্তাহ জুড়ে শর্ত দিয়ে তেল বিক্রি করেছে। যখনি সরকার লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই বাজারে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিন কোম্পানি তীর, ফ্রেশ ও পুষ্টির তেল চলে এসেছে।’
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গেল মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোজ্য তেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এতে করে বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম কমার কথা থাকলেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নানা কারসাজিতে সরকার সয়াবিন তেল লিটারে ৮ টাকা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। এতে করে নিম্নআয়ের মানুষের আয় না বাড়লেও আরেক ধাপ খরচের চাপ বাড়ল। নতুন করে তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার ব্যবসায়ীদের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।