
থোকায় থোকায় মরিয়ম জাতের খেজুরে দুলছে বাহরাইন ফেরত সাতক্ষীরার কৃষক শোকর আলীর স্বপ্ন
এসএম শহীদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা
থোকায় থোকায় হলুদিয়া বর্ণের মরিয়ম জাতের খেজুরে দুলছে কৃষক শোকর আলীর স্বপ্ন।
দেশের কৃষিতে খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে কালিগঞ্জ উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের নরহরকাটি গ্রামের বাসিন্দা শোকর আলী।
২০১৮ সালে জীবিকার তাগিদে বাহরাইন যান শোকর আলী। কিন্তু ভাগ্য বদলাতে পারেননি। সেখানে খেজুর বাগানে কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, খেজুর এমন একটি ফল, যা দীর্ঘমেয়াদে কম পরিচর্যায় ভালো ফলন দেয়। ২০২১ সালে দেশে ফেরার সময় তিনি সঙ্গে আনেন উন্নত জাতের প্রায় ৫০টি খেজুরের বীজ। নিজের আঙিনায় সেই বীজ থেকেই শুরু হয় চারার উৎপাদন। পরে তার দুই ছেলের মধ্যে একজনকে পাঠান বাহরাইন ও অন্যজনকে সৌদি আরবে, যাদের মাধ্যমে আরও উচ্চফলনশীল জাতের বীজ সংগ্রহ করে নার্সারিকে পরিপূর্ণ করে তোলেন।
বর্তমানে তার নার্সারিতে ১০-১২ হাজার খেজুর চারা রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু গাছে ফল আসতে শুরু করেছে। শোকর আলীর বাগানে ফলসহ মরিয়ম খেজুরগাছটি লম্বায় পাঁচ ফুট। গাছটিতে রয়েছে সাতটি খেজুরের ছড়া (থোকা)। খেজুরের ভারে ছড়াগুলো প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই।
প্রতিটিতে থোকায় যে পরিমাণ খেজুর এসেছে, তার ওজন তিন থেকে সাড়ে তিন কেজির মতো হবে বলে জানালেন শোকর আলী। তিনি বললেন, তাঁর বসতভিটাটি ১৫ কাঠা জায়গার ওপর। এর মধ্যে প্রায় ১২ কাঠা জায়গাতেই খেজুরের চারা রোপণ করেছেন তিনি। গত বছর থেকে নিয়মিত চারা বিক্রি করছেন। জেলার বাইরে থেকেও লোকজন চারা কিনতে আসছেন। প্রতিটি চারা ২০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করছেন তিনি।
ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ১৬ হাজার মরিয়ম জাতের খেজুরের চারা নিজের এই নার্সারিতে রয়েছে বলে জানালেন শোকর আলী। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তিনি আলাদাভাবে দুই বিঘা জমি ইজারা নিয়েছেন।
শোকর আলী বলেন, ‘আমি ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাহরাইনে ছিলাম। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। তবে সেখানে খেজুরবাগানে কাজ করার যে অভিজ্ঞতা, তা দিয়ে এখন আর্থিকভাবে সফল হওয়ার চেষ্টা করছি।’
দেশে এই গাছ চাষের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না বলে জানালেন শোকর আলী। তিনি বলেন, দেশি গাছে যে ধরনের পরিচর্যা, একই পরিচর্যা মরিয়ম জাতের খেজুরগাছের জন্যও। প্রতি বিঘা জমিতে ১২০টি খেজুরগাছ রোপণ করা সম্ভব। প্রথম ও দ্বিতীয় বছরে গাছে ফল এলে কেটে ফেলতে হয়। কারণ, চারা গাছের ফল কেটে না দিলে গাছ বড় হয় না।
গাছে ফল আসার তিন মাসের মাথায় মরিয়ম খেজুর পেকে যায় বলে জানালেন শোকর আলী। তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর যে গাছটিতে খেজুর এসেছে, তা আর ২০ দিনের মধ্যে পেকে যাবে বলে তিনি ধারণা করছেন।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে খেজুর বিক্রি করতে পারবেন বলে আশাবাদী শোকর আলী। তিনি বলেন, ‘চেষ্টার কোনো শেষ নেই আর মাবুদ যদি রহম করেন, সফল হতে সময় লাগবে না।’
কালিগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওয়াসিম উদ্দিন জানান, শোকর আলীর নার্সারিতে ইতোমধ্যে উন্নত জাতের কিছু গাছে ফলন দেখা দিয়েছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। উপকূলীয় মাটি ও জলবায়ু বিবেচনায় পরীক্ষামূলকভাবে উন্নত জাতের খেজুর চাষ সফল হলে বড় পরিসরে তা সম্প্রসারণ সম্ভব।
একই উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের শফিউল্লাহও সৌদি খেজুরের বীজ থেকে নিজের চিংড়ি ঘেরের বেড়িবাঁধে খেজুর চাষ করে সফলতা পেয়েছেন।
শোকর আলীর প্রতিবেশী মৎস্য চাষি আবু মুছাও তাঁর মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধে লাগিয়েছেন ২১টি মরিয়ম জাতের খেজুরগাছের চারা। খেজুর চাষে আবু মুছাও পেয়েছেন সফলতা।
সাতক্ষীরা হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আমজাদ হোসেন বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও পানির বৈশিষ্ট্য স্থানভেদে ভিন্ন। তবে খেজুর একটি তুলনামূলকভাবে খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ছোট পরিসরে বিভিন্ন এলাকায় খেজুর চাষ করে উপযোগিতা যাচাই করা যেতে পারে। যদি এসব পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়, তবে পরিকল্পিতভাবে বড় পরিসরে খেজুর চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে প্রতিবছর রমজানসহ অন্যান্য সময়ে কয়েক হাজার মেট্রিক টন খেজুর আমদানি করতে হয়। দেশেই উন্নত জাতের খেজুর উৎপাদন শুরু হলে আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে, বাড়বে কৃষকের আয়। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে খরাপ্রবণ সহনশীল খেজুর চাষ নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে। প্রয়োজন শুধু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি বিভাগ ও সরকারের যথাযথ সহায়তা। শোকর আলীর এই সবুজ স্বপ্ন বদলে দিতে পারে উপকূলীয় কৃষির ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশকে এনে দিতে পারে খেজুরে স্বয়ংসম্পূর্ণতার আশ্বাস।
মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন
আপনি ও পছন্দ করতে পারেন
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
আর্কাইভ!
অনুগ্রহ করে একটি তারিখ নির্বাচন করুন!
দাখিল করুন